‘ম্যায় অটল হুঁ’ ছবির একটি দৃশ্যে পঙ্কজ ত্রিপাঠী। ছবি: সংগৃহীত।
পঙ্কজ ত্রিপাঠী। পঙ্কজ ত্রিপাঠী। এবং পঙ্কজ ত্রিপাঠী।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রায় সাড়ে সাত দশকের কর্মজীবনকে ‘ম্যায় অটল হুঁ’ ছবিতে বাঁধতে চেয়েছেন প্রযোজক বিনোদ ভানুশালী এবং পরিচালক রবি যাদব। আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় তাঁরা ধরতে পেরেছেন শুধু ওই একটিই নাম— পঙ্কজ ত্রিপাঠী।
ছবি দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’। বা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে তৈরি একটি টিভি মুভি, ‘ম্যান্ডেলা’। প্রথমটি কালজয়ী। দ্বিতীয়টি নিতান্তই টেলিভিশনের জন্য তৈরি। কিন্তু দুই দেশনেতাকে রুপোলি পর্দায় বাঁধার সময়ে পরিচালক-প্রযোজকেরা দোষগুণ মিলিয়েই চরিত্র তৈরি করেছেন।
এখানেই ‘অটল’ পিছিয়ে যায়। মানছি, এখন সময়টাই কাহিনিকে কল্পকথার মোড়কে পরিবেশন করার। রামমন্দির উদ্বোধনের মাত্র তিন দিন আগে মুক্তি পেয়েছে ‘অটল’। ফলে রাজনৈতিক প্যাকেজিংয়ের বিষয়টি আলাদা করে উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। এই সিনেমার তাই অন্যতম বড় উদ্দেশ্য, জীবনের চেয়ে বড় চরিত্রচিত্রণের চেষ্টা। আর সেটা করতে গিয়ে বাদ পড়েছে বাজপেয়ীর রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ঘটনা। এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বিতর্কিত কিছু বিষয়।
অথচ বাজপেয়ীর জীবন এমনই বর্ণময় এবং ঘটনাবহুল যে, তাতে বাড়তি রং চাপানোর প্রয়োজন নেই। স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে তাঁর যোগদান থেকে শুরু করে সংসদে জনসঙ্ঘের প্রতিনিধি হয়ে খোদ জওহরলাল নেহরুর সামনে জোরালো বক্তৃতা— এই যদি শুরুর পর্ব হয়, তবে ক্লাইম্যাক্সে আসে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ দিক। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপির উত্থান। তার পরে আডবাণীর রথযাত্রা, এনডিএ-র সরকার গঠন, লাহৌর বাসযাত্রা, কার্গিল, পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ, সংসদে জঙ্গি হানা, গুজরাত দাঙ্গার পরে নরেন্দ্র মোদীকে পাশে বসিয়ে রাজধর্ম পালন নিয়ে বার্তা, ভারত উদয়ের প্রচার এবং সর্বোপরি লোকসভা ভোটে হার।
এগুলিকে এক সুতোয় বাঁধলেই ছবি জমে যাওয়ার কথা। কিন্তু প্রযোজক-পরিচালক কার্গিলে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। না আছে সংসদে জঙ্গি হানা, না আছে গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গার কথা। নরেন্দ্র মোদী প্রসঙ্গ তো বাদই দিলাম। এর সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে সত্যের বিচ্যুতি ঘটেছে।
যেমন, পোখরান বিস্ফোরণ। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রথমবার রাজস্থানের পোখরানে পরীক্ষামূলক ভাবে পরমাণু বোমা ফাটান। সে ঘটনার উল্লেখ নেই, মানা গেল। তা বলে ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় পোখরান বিস্ফোরণের সময়ে তৎকালীন মন্ত্রিসভায় দু’নম্বর, লালকৃষ্ণ আডবাণীকে (রাজা রামেশকুমার সেবক) কিছু জানাননি বাজপেয়ী— এটা সম্ভব? অথচ বাস্তব বলছে, বিস্ফোরণের আগের দিন হঠাৎই বিদেশ সফর বাতিল করেছিলেন আডবাণী। পরে আডবাণী বলেছিলেন, বিস্ফোরণের কথা স্ত্রীকে পর্যন্ত জানাননি। কিন্তু সিনেমায় তার নামগন্ধ নেই।
লাহৌর বাসযাত্রা এবং কার্গিল যুদ্ধ রইল, অথচ পারভেজ মুশারফের আগরা বৈঠক বাদ গেল? সেটুকু না হলে যে পাকিস্তানের সঙ্গে বাজপেয়ীর দৌত্যের ছবিটা পূর্ণ হয় না!
তা হলে ছবিটিতে কি শুধুই পঙ্কজ? না। আছে বাজপেয়ীর জীবনের অন্য আরও কিছু দিক। আছে তাঁর জটিল ব্যক্তিগত জীবনের ঝলক। আছে স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর ও দলের লড়াই। সেখানে দেখানো হয়েছে, কী ভাবে বিরোধীদের দমিয়ে রাখতে সরকার হয় কৌশল, নয় বুলেটের সাহায্য নিচ্ছে। নয়তো জেলে ভরছে বিরোধীদের। দেখানো হয়েছে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (প্রমোদ পাঠক) এবং দীনদয়াল উপাধ্যায়ের (দয়াশঙ্কর পাণ্ডে) রহস্যজনক মৃত্যু। এই সব দমন-পীড়ন, দল ভাঙানো— চেনা চেনা ঠেকছে?
দেখানো হয়েছে সাংবাদিক বৈঠক জমিয়ে দেওয়া বাজপেয়ীকে। এবং তাঁর বাগ্মিতা। রয়েছে সেই বিখ্যাত ভাষণ, যেখানে তিনি বলেছিলেন: ইয়ে দেশ রহেনা চাহিয়ে, ইয়ে দেশকা লোকতন্ত্র রহেনা চাহিয়ে। দেখানো হয়েছে বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে তাঁর সেই বিতর্কিত ভাষণের অংশও।
এইটুকু সময়ে এত ঘটনাকে আঁটাতে গেলে যা হয়, সিনেমা কখনওই দানা বাঁধেনি। ক্লাইম্যাক্সও নেই। তবে সিনেমাটোগ্রাফি কিছু জায়গায় বেশ ভাল। দু’-একটি গান ভালই লাগে। পুরনো দিনের সেট তৈরিতে কিছু ক্ষেত্রে সাজানো মনে হয়। তবে সামগ্রিক ভাবে বিশেষ খুঁত নেই।
এই ছবিতে পঙ্কজ ছাড়া আর যদি দ্বিতীয় কিছুকে সাধুবাদ দিতে হয়, তা হল অভিনেতা বাছাই ও প্রস্থেটিক মেকআপ। এমন বাজপেয়ীর পাশে যদি মানানসই আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশী, সুষমা স্বরাজ, প্রমোদ মহাজন বা অরুণ জেটলি না থাকেন, তবে কি রাজনীতির বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়?
অটলপ্রেমীদের কাছে একটা অনুরোধ, ছবির শেষে টাইটেল কার্ডটা দেখবেন। ভাল লাগবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy