নান্দীকারের নাটক দেখেতে নবদ্বীপের রবীন্দ্র সংস্কৃতি মঞ্চের সামনে লম্বা লাইন। বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
নাটকের ছ’দিন আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিল সব প্রবেশপত্র। সাড়ে আটশো আসনের হলের প্রবেশপত্র শেষ? বিশ্বাস হয়নি কারও। বাধ্য হয়ে নাটকের চার দিন আগে শহরে মাইক বের করে ঘোষণা করতে হল— ‘টিকিট চেয়ে লজ্জা দেবেন না।’
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নান্দীকারের নাটক ‘মাধবী’ প্রদর্শন ঘিরে এমনই অভাবনীয় সব ছবি দেখল নবদ্বীপ। শুধু কি তাই? শুধু নাটকের জন্যই এ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ আমলা কলকাতামুখো হলেন না। আদালতের সরকারি কৌঁসুলি হলের সামনে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ালেন ‘আরও একটি’ প্রবেশপত্রের খোঁজে। হাওড়া হাটের কাজ দ্রুত শেষ করে শহরের ব্যবসায়ী স্টেশন থেকে পড়িমড়ি করে ছুটলেন হলে। নাটক দেখতে না পাওয়ার ক্ষোভে শহরের অনেক নাট্যকর্মী উদ্যোক্তাদের তুমুল সমালোচনা করলেন। ‘যত টাকা লাগে দেব’ বলেও শেষ মুহূর্তে টিকিট না পাওয়া দর্শক প্রবল অসন্তোষ নিয়ে ফিরলেন।
প্রবেশপত্র না পেয়ে বিষণ্ণ শহরের প্রবীণ নাট্যকর্মী মলয় লাহিড়ীর আক্ষেপ, “খুব খারাপ লাগছে। আমার শহরে ‘মাধবী’ হচ্ছে, আর আমি দেখতে পেলাম না। আমাদের কেউ কিছু বলারও প্রয়োজন বোধ করে না। যখন জানলাম, ততক্ষণে সব ফুরিয়ে গিয়েছে। ”
প্রবেশপত্র হাতে পেয়েও আবার নবদ্বীপের তাবড় নাগরিকও দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেন নাটক দেখার অপেক্ষায়। বিকেল পাঁচটা নাগাদ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কাস্টমসের পদস্থ কর্তা জয়ন্ত সিংহ বলেন, “পনেরো দিন আগে ছুটির ব্যবস্থা করে রেখেছি আজকের জন্য।” নাটক দেখতে এসেছিলেন শহরের প্রবীণ নাট্য পরিচালক সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গে অভিনেতা সমীর ভট্টাচার্য। আশির কাছাকাছি বয়সের প্রবীণ মানুষটি নাট্যজগতে ‘মন্টুদা’ নামেই পরিচিত। কার্যত নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখা সেই মন্টুদাকে বহুদিন পরে দেখা গেল প্রতীক্ষার সারিতে।
নবদ্বীপ সায়কের ২৮ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে নতুন রবীন্দ্র সংস্কৃতি মঞ্চে এই প্রদর্শনের আয়োজন। নাটকের শহর নবদ্বীপে এত দিন কোনও স্থায়ী নাট্যমঞ্চ না থাকা নিয়ে নাট্যমোদী নাগরিকদের প্রবল আক্ষেপ ছিল। খেদ ছিল, ভাল নাটক তাঁরা দেখতে পান না। মাস তিনেক আগে নবদ্বীপ পুরসভার উদ্যোগে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ হয়েছে। তার পরে এই প্রথম কোনও বড় দলের নামকরা প্রযোজনা মঞ্চস্থ হল। স্বাভাবিক ভাবেই, কেউ তা দেখার সুযোগ ছাড়তে চাননি।
আয়োজক সংস্থার তরফে মোহন রায় জানান, ‘‘আমরা গত আড়াই দশকে নবদ্বীপে বেশ কিছু ভাল নাটক এনেছি। কিন্তু নান্দীকারের মতো দলের ‘মাধবী’র মতো বহুচর্চিত নাটক আনার সাধ থাকেলও সাধ্য ছিল না। নতুন হল হওয়ার পরে ইচ্ছেটা আবার মাথাচাড়া দেয় এবং তারই স্বপ্নপূরণ হল। এই প্রথম আমরা কোনও নাটক প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে লোকের দরজায় না ঘুরেই সাফল্য পেলাম।”
নাটকের চার দিন আগে মাইকে ঘোষণা করতে হয়েছে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। তা শুনে নান্দীকার প্রধান রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেন, “আগেই শুনেছিলাম টিকিটের খুব চাহিদা। তার পরে দেখলাম, লোকে রাস্তায় লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নাটক দেখবেন বলে। সব শুনে এক দিকে গর্ব হয়। নান্দীকারের নাটক দেখবেন বলে মানুষের আগ্রহ দেখে তৃপ্তিও হয়।” হাসতে-হাসতেই তিনি যোগ করেন, “অন্য দিকে এক বার মনে হচ্ছে, সে ভাবে কিছু হয় না বলেই এই ভিড় নয়তো? তবে নাটকের আদিপুরুষ খোদ চৈতন্যদেবের শহরে অভিনয়ের সুযোগ এবং এমন বিপুল সাড়ায় আমরা অভিভূত।”
ঘটনাচক্রে, মঙ্গলবারই ‘মাধবী’র ১৫০তম অভিনয় হল। কিন্তু কেন এই আশ্চর্য উন্মাদনা?
নবদ্বীপে এটা স্বাভাবিক— বলছে শহরের ইতিহাস। চৈতন্যদেবের হাত ধরে যেখানে নাট্যচর্চার সূচনা, যে শহরে আধুনিক যাত্রার রূপকার মোতিলাল রায়ের জন্ম, যে শহরে পরিচালক নিতাই ভট্টাচার্যের জন্ম, অমর গঙ্গোপাধায়ের জন্ম, সেই শহরে মানুষ নাটকের জন্য এমন করবেন, এটা প্রায় প্রত্যাশিত। চেতনার ‘জগ্ননাথ’, হাবিব তনবিরের ‘চরণদাস চোর’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রাণতপস্যা’ বা বিভাস চক্রবর্তীর ‘মাধব মালঞ্চি কইন্যা’ নবদ্বীপ দেখেছে। কিন্তু তাতে উদ্যোক্তাদের প্রাণপাত পরিশ্রম থাকলেও নাটক মঞ্চায়নের উপযুক্ত পরিবেশ পাননি অভিনেতা এবং দর্শকেরা। স্থায়ীমঞ্চে এ বার নাটকের নতুন অধ্যায় শুরু হল— বলছে নবদ্বীপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy