বেঁচে থাকতেই তাঁর নামের আগে তকমা লেগেছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘ট্র্যাজেডি কুইন’। পর্দায় তাঁকে চোখের জল ফেলতে দেখলে নাকি আসমুদ্রহিমাচল হুতোশে গুমরোত! মীনা কুমারীর মতো একজন অভিনেত্রীর উপরে এ-ধরনের তকমা তাঁকে নিয়ে আলোচনার পরিসর বড্ড একপেশে করে দেয় বলে মনে হয়। তবে, অন্য দিকে তাঁর কাজ এবং কাজের সঙ্গে জুড়ে থাকা জীবনের পর্যালোচনা করলে ‘ট্র্যাজিক’ বিশেষণটি অনন্য এক তাৎপর্য পায়। মীনা কুমারীর জীবদ্দশায় পেশাদারি সাফল্য ও বিপুল খ্যাতির সঙ্গেই যেন তাল রাখছিল তাঁর ভাঙাচোরা শৈশব, ধ্বস্ত ও জটিল দাম্পত্য, প্রেমে ব্যর্থতা এবং আত্মীয়-ঘনিষ্ঠদের বিশ্বাসঘাতকতা। ‘জিন্দগী ইয়ে হ্যয়’ কবিতায় মীনা লিখছেন,
‘দর্দ কে সায়ে, উদাসী কা ধুঁয়া, দুখ কি ঘটা
জিন্দগী ইয়ে হ্যয় তো ফির মওত কিসে কহতে হ্যয়’
(বেদনার ছায়া, ধোঁয়ার মতো ঘিরে থাকা বিষণ্ণতা, দুঃখের মেঘ, এ-যদি জীবন হয়, তাহলে কাকে বলে মৃত্যু!)।
আবার, অন্য দিকে মনে হয়, যে বিমর্ষ বিষাদ অন্তহীন সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনায় তিনি ফুটিয়ে তুলতেন তাঁর সাবলীল অভিনয়ের মাধ্যমে একের পর এক চরিত্রে, তাঁর নিজের মনকেও কি তিনি সেই বিষাদের হিমশীতল আলো-আঁধারিতেই নিমজ্জিত রেখেছিলেন আজীবন? হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চাওয়াটাই কি ছিল তাঁর শিল্পীসত্তার স্বাভাবিক প্রকাশ? নাকি, জাত শিল্পীদের ধরনে ব্যক্তিজীবনের ঘটনাপ্রবাহের উত্তপ্ত খাদহীন অভিঘাতই হয়ে উঠত তাঁর শিল্পের উপাদান?
নায়িকা এবং অভিনেত্রী হিসাবে খ্যাতির সাফল্য-শীর্ষে পৌঁছোনোর পরেও মীনা কুমারীর জীবন ছিল, জীবনানন্দ দাশের ভাষা ধার করে বলতে হয়, ‘বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা’। অন্য অভিনেত্রীদের সঙ্গে মীনা কুমারীর প্রধান পার্থক্য— যে পার্থক্য একান্ত ভাবে বোধহয় তাঁরই বৈশিষ্ট্য সেটা হল, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজগুলি কোনও না কোনও ভাবে সরাসরি, প্রায় সরল রেখার মতো তাঁর যাপিত অস্তিত্বকেই স্পর্শ করে গিয়েছে। মীনা কুমারী পরিচালক ছিলেন না। তিনি অন্যের ছবিতে অভিনয় করতেন। সে-দিক দিয়ে দেখলে চরিত্র আর জীবনের এই মিলগুলো কি আকস্মিক, নিছক সমাপতন? ‘ছোটি বহু’ (সাহিব, বিবি অউর গুলাম), ‘সাহিবজান’ (পাকিজ়া), ‘করুণা’র (দিল আপনা অউর প্রীত পরাই) মতো চরিত্রে সরাসরি মীনা কুমারীরই জীবনের টুকরো খুঁজে পাই যেন। জীবনের অন্তিম পর্বে, যখন মাত্রাতিরিক্ত সুরার বিষ তাঁকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মধ্বংসের পথে, সে প্রসঙ্গে ‘সাহিব, বিবি অউর গুলাম’-এর পরিচালক আব্রার আলভির স্মৃতিচারণ: ‘সে বড় ট্র্যাজিক দৃশ্য ছিল আমার কাছে। মদের নেশায় (মীনা) নিজেকে যে-ভাবে ডোবাতে শুরু করেছিল, তাতে মনে হচ্ছিল ছোটি বহু-র গল্পটিই বাস্তব পরিণতি পাচ্ছে’।
এখানে আর একটা কথা বলা দরকার, ছবি এবং ব্যক্তিজীবনে যে মীনা কুমারীকে আমরা দেখি, তারই পরিপূরক তাঁর কাব্যগুচ্ছ। ১৯৬৪ সালে নিজের লেখা কয়েকটি গজ়ল, শের ও নজ়ম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল মীনা কুমারী ‘নাজ়’-এর এলপি অ্যালবাম, ‘আই রাইট, আই রিসাইট’। উর্দু কবিদের রীতিমাফিক মীনা কুমারীও কবিতা লেখার জন্য একটি ‘তখল্লুস’ (ছদ্মনাম বা উপাধি) বেছে নিয়েছিলেন, সেটা হল ‘নাজ়’ (গর্ব, অহংকার)। ১৯৭২ সালে মীনার মৃত্যুর পর পরই তাঁর শায়রী ‘তনহা চাঁদ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় তাঁর ঘনিষ্ঠ গীতিকার গুলজ়ারের সম্পাদনায়। মৃত্যুর আগে অভিনেত্রী নিজের যাবতীয় ডায়েরি ও কবিতার খাতা তাঁকেই দিয়ে গিয়েছিলেন।
মীনা কুমারী তাঁর পেশাকে স্বেচ্ছায় নির্বাচন করেননি, কোনও আকস্মিক সুযোগ ঘটিয়ে সিনেমা-জগৎ তার দরজা তাঁর সামনে খুলে দেয়নি। সে-সবের প্রয়োজনও ছিল না। যাঁর প্রায় চল্লিশ বছরের আয়ুষ্কালের চৌত্রিশ বছরই কেটেছে ক্যামেরার সামনে, তাঁর সম্পর্কে বলা চলে, এটা ছিল তাঁর অমোঘ ভবিতব্য। ছ’বছরের মাহজ়বিন বানো (মীনা কুমারীর প্রকৃত নাম) যেদিন ২৫ টাকা বেতনে বিজয় ভট্টের ছবি ‘লেদার ফেস’-এ (১৯৩৯) শিশুশিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন, সেদিন কি তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝেছিলেন এই কাজটাই তাঁকে আমৃত্যু করে যেতে হবে?
একবার রেডিয়ো সাক্ষাৎকারে আমিন সায়ানি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অল্পবয়সে যখন সকলেই স্কুলে যায়, আপনি বেছে নিয়েছিলেন স্টুডিয়োকে। কেন?’ অভিমান আর অভিযোগ মেশানো ছোট্ট হাসি হেসে মীনা উত্তর দেন, ‘আমি বেছে নিইনি। নিয়তিই টেনে এনেছে। চেয়েছিলাম স্কুলে যাব, লেখাপড়া শিখে ডাক্তার, উকিল কিছু একটা হব। আমার নিয়তিই আমায় সিনেমা অভিনেত্রী বানিয়েছে।’
স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে শিশুকন্যাকে সিনেমায় নামানোর সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন মীনার পিতা, পার্সি থিয়েটারের হারমোনিয়ম-বাদক ‘মাস্টার’ জনাব আলি বকশ। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল খুবই স্পষ্ট ও সরল— অভাবের সংসারে লেখাপড়া বা খেলাধুলোর মতো ‘বাজে’ কাজে সময় নষ্ট না করে মেয়েরা যদি চটপট কিছু উপার্জন করতে পারে! মেয়ের ছবি নিয়ে বিভিন্ন প্রোডিউসার-পরিচালকদের দরজায় দরজায় ঘুরতেন আলি বক্স — ‘মেয়ে আমার দেখতে-শুনতে ভাল, নাচতে-গাইতে পারে, শিশুশিল্পী দরকার হলে জানাবেন।’
স্বামী কামাল আমরোহির সঙ্গে মীনা কুমারী। ছবি: সংগৃহীত।
গত শতকের বিশের দশকের কোনও সময়ে স্ত্রী-সন্তানদের জন্মস্থান লাহৌরে রেখে মুম্বই পৌঁছন ভাগ্যান্বেষী আলি বকশ। মুম্বইয়ের থিয়েটারে পরিচয় হয় প্রভাবতী নামে এক বাঙালি-খ্রিস্টান নৃত্যশিল্পী, তথা নির্বাক ছবির এক হিরোইনের সঙ্গে। প্রচলিত জনশ্রুতি, প্রভাবতীর মা হেমসুন্দরী ছিলেন পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের প্রথম পুরুষ দর্পনারায়ণ ঠাকুরের কোনও এক বংশধরের বধূ (বিভিন্ন লেখায় এমন উল্লেখ থাকলেও এর সপক্ষে কোনও বিশ্বাসযোগ্য নথি আমি পাইনি)। তবে, এটা ঘটনা যে, হেমসুন্দরী বাঙালি ছিলেন। অল্পবয়সে স্বামীকে হারিয়ে তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে নার্সের চাকরি নিয়ে মেরঠে যান এবং সেখানে নতুন সংসার পাতেন। সেখানে তাঁর দুই কন্যাসন্তান জন্মায়, তাঁদেরই একজন প্রভাবতী। আলি বকশকে ‘নিকাহ’ করার আগে প্রভাবতী ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন, নতুন নাম হয় ইকবাল বেগম।
আলি বকশ ও ইকবালের তিন কন্যা। মেজ মেয়ে মীনার জন্মের তারিখ ১ অগস্ট। সাল ১৯৩২ অথবা ১৯৩৩। দ্বিতীয় এই সন্তানও কন্যা হওয়ায় ক্ষিপ্ত আলি বকশ সদ্যোজাত শিশুটিকে অনাথাশ্রমে ফেলে আসেন। পরে এক বন্ধুর গালমন্দ শুনে ফের বাড়িতে এনে নাম রাখেন মাহজ়বিন (অর্থাৎ,‘চন্দ্রমুখী’)।
শিশু মাহজ়বিনকে ছবিতে সুযোগ দেওয়ার সময়েই বিজয় ভট্ট আপত্তি তুলেছিলেন শিল্পীর নাম নিয়ে। মাহজ়বিন নামটা তাঁর কানে কর্কশ লেগেছিল সম্ভবত (ভুললে চলবে না, সে-কালে হিন্দি ছবিতে বহু মুসলিম অভিনেতা-অভিনেত্রী— বিশেষ করে অভিনেত্রীদের সর্বভারতীয় ‘দর্শক’দের কাছে ‘গ্রহণীয়’ করে তোলার জন্য হিন্দু নাম দেওয়া হত। যে-কারণে মহম্মদ ইউসুফ খান হয়েছিলেন ‘দিলীপ কুমার’, মুমতাজ জেহান দেহলভি হন ‘মধুবালা’, খুরশিদ আখতার হন ‘শ্যামা’, ইত্যাদি।), তাই তিনি সেই নাম পাল্টে করে দেন ‘বেবি মীনা’। পরের কয়েকটি বছর বেবি মীনার কর্মক্ষেত্র হয় হোমি ওয়াডিয়ার ‘বসন্ত স্টুডিয়ো’। ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’, ‘শ্রী গণেশ মহিমা’, প্রভৃতি হিন্দু পৌরাণিক ছবিতে কাজ করতে থাকেন। ধর্মনিষ্ঠ সুন্নি মুসলিম পরিবারের বাচ্চা মেয়ে, হিন্দু শাস্ত্র-পুরাণ সম্পর্কে কোনও প্রাথমিক ধারণা না-থাকা সত্ত্বেও ওই সব পৌরাণিক ছবিতে বেবি মীনার সাবলীল অভিনয় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। অনেকের মতে, ওঁর অভিনীত শ্রেষ্ঠ ছবি ‘সাহিব, বিবি অউর গুলাম’-এ ছোটি বহু-র চরিত্রেও এটাই হয়েছিল। কাহিনির সময়কাল উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথম দিক। সে-আমলের বাঙালি হিন্দু ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পরিবারের রীতি-প্রথা-সংস্কারের সঙ্গে মীনা কুমারীর আজন্মলালিত সংস্কারের প্রভেদ অনেক। কিন্তু গোটা ছবিতে একমাত্র ওঁর অভিনয়েই সেই প্রভেদ মুহূর্তের জন্যও চোখে পড়ে না।
বড় হয়ে ওঠার বছরগুলিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনও সুযোগ না ঘটলেও নিজস্ব জেদে লেখাপড়া শেখেন মীনা। দিনের অধিকাংশ সময় স্টুডিয়োয় কাটত তাঁর। তার মধ্যেই যেটুকু ফুরসৎ পেতেন নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন পড়াশোনায়, বিশেষ করে সাহিত্য-পাঠে। সে-আমলে হিন্দি ছবির জগতে গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ লেখকদের অধিকাংশই ছিলেন নামজাদা সাহিত্যিক। যেমন, সাহির লুধিয়ানভি, শাকিল বদায়ুঁনি, শৈলেন্দ্র, কামাল আমরোহি, কইফি আজ়মি, আব্রার আলভি, গুলজ়ার প্রমুখ। এঁদের মধ্যে অন্তত তিনজন— কামাল আমরোহি, আলভি এবং গুলজ়ারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল মীনা’র। কামাল আমরোহি হয়ে ওঠেন তাঁর প্রথম প্রেমিক এবং স্বামী।
স্বামী কামাল আমরোহির সঙ্গে মীনা কুমারী। ছবি: সংগৃহীত।
কামাল আমরোহি ও মীনা কুমারীর দাম্পত্যের টানাপড়েন নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। প্রচলিত ধারণা, সেই নাটকে আমরোহি-ই খলনায়ক। তবে বিষয়টি অত সরল মনে হয় না। মীনা কুমারীর ফিল্মি কেরিয়ার আর ব্যক্তিজীবন এমন ভাবে পাকে-পাকে, পরতে-পরতে জড়িয়ে রয়েছে যে, একটাকে বাদ দিলে অন্যটা বোঝা কঠিন হয়। সেই পাকের এক দিকে তাঁর পিতা আলি বক্স, অন্য দিকে তাঁর আদরের চন্দন, ওরফে কামাল আমরোহি।
সোহরাব মোদীর ছবির জন্য শিশুশিল্পী খুঁজতে গিয়ে বেবি মীনার সঙ্গে প্রথম মোলাকাত হয় কামালের। তখন মীনার বয়স ছয়-সাত, কামাল কুড়ির কোঠায়। এর বহু বছর পরে ফণী মজুদারের ‘তামাশা’ (১৯৫২) ছবির শুটিংয়ে অষ্টাদশী মীনার সঙ্গে মধ্য ত্রিশের কামালের পরিচয় করিয়ে দেন অশোক কুমার। বাচ্চা বয়সে আলাপের স্মৃতি মীনার মন থেকে মুছে গেলেও কামাল আমরোহি তত দিনে হয়ে উঠেছেন তাঁর স্বপ্নের পুরুষ! ওই ঘটনার কয়েকবছর আগেই দারুণ সাড়া ফেলেছিল কামালের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘মহল’ (১৯৪৯)। বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, সাহিত্যের সমঝদার, চিত্রনাট্য লেখার ব্যাপারে প্রযোজক-পরিচালকদের সঙ্গে আপস না করা কামাল তখন হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তরুণ তুর্কি! তবে, সিনেমা ব্যক্তিত্বটির নয়, রোমান্টিক স্বপ্নে বিভোর তরুণী মীনা প্রেমে পড়েছিলেন ‘লেখক’ কামাল আমরোহির! ততদিনে কামাল বিবাহিত এবং তিনটি সন্তানের জনক। তাতে অবশ্য প্রেম এবং বিয়ে আটকায়নি। যদিও বিয়ের সংবাদ এক বছর গোপন রেখেছিলেন দু’জনেই। আলি বকশের আপত্তির কারণে ঘটনাটি গোপন রাখতে বলেন মীনাই। আপত্তির কারণ অবশ্য পাত্রকে অপছন্দ নয়, মেয়ে পরের ঘরে গেলে তিনি পরিণত বয়সে যে বিত্তবৈভবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, সেটা হাতছাড়া হওয়ার আতঙ্ক। মীনা কুমারী অভিনয় জীবন শুরু করার সময় থেকেই মেয়ের ম্যানেজার হয়ে ছিলেন আলি বকশ। ছবি নির্বাচন, শুটিংয়ের ডেট থেকে নায়িকার পারিশ্রমিক, সবই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। বাপ যে তাঁর উপার্জনের উপরেই নির্ভরশীল সেটা মীনা কুমারীও বুঝতেন। বিয়ের আগেই স্বামীকে জানিয়ে দেন, আলি বকশের হাতে অন্তত দু’লক্ষ টাকা তুলে দিয়ে তবেই নতুন সংসার পাতবেন তাঁরা। ভাবী স্ত্রীর শর্ত মেনে নেন কামাল। তবে, বিয়ের খবর আলি বকশের গোচরে আসতেই বাপ-মেয়েতে বেধে যায় তুমুল অশান্তি।
মীনা কুমারীর স্বকণ্ঠে ওঁর নিজস্ব কবিতা পাঠের এলপি রেকর্ডের (যা এখন দুষ্প্রাপ্য) কভার। ছবি: সংগৃহীত।
গোপনে বিয়ের এক বছর পর, ১৯৫৩ সালের ১৪ অগস্ট, কামাল আমরোহির ‘দায়েরা’ ছবির শুটিং সেরে নিজের বাড়ি ফেরেননি মীনা। স্টুডিয়ো থেকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে যান কামাল আমরোহির বাড়ি। তিনি সে-রাতে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে দেখে হতবাক! সেই রাতেই আলি বকশকে চিঠিতে লেখেন মীনা, ‘বাবুজি, আমি তোমার বাড়ি ছেড়ে এসেছি। এ নিয়ে আইন-আদালত কোরো না, সেটা ছেলেমানুষি হবে। গাড়ি তোমায় কালই পাঠিয়ে দেব। শুধু আমার বইপত্র ও পোশাকগুলো সুবিধামতো পাঠিয়ে দিও। এ চিঠির উত্তর ফোনে বা চিঠিতে দিও’। ঘটনাচক্রে, মীনা আসার আগেই আগের স্ত্রী বিলকিস ও সন্তানদের তাঁর গ্রামের বাড়ি আমরোহায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কামাল। বাকি জীবন মোটামুটি সেখানেই কাটিয়েছেন বিলকিস। তাঁর দুই সন্তান তাজদার ও রুকসারের বয়ানে, পরে মীনাজিকে মেনে নিলেও বিয়ের খবরে খুবই ভেঙে পড়েছিলেন বিলকিস। মীনার সঙ্গে তাঁর প্রেম ও পরিণয়ের খবর বিলকিসকে দেননি কামাল আমরোহি, তিনি তাঁর স্বামীর ‘কীর্তি’ জেনেছিলেন খবরের কাগজ থেকে!
স্বামীর ঘরে এসে মীনা কুমারীর জীবনে কি তেমন কোনও পরিবর্তন ঘটেছিল? তথ্য বলছে, না। মীনা কুমারীর জীবন এবং কেরিয়ার ‘পরিচালনা’র দায়িত্ব এতদিন আলি বকশ যে-ভাবে সামলাতেন, এ বার ঠিক সেই দায়িত্বই নিলেন কামাল আমরোহি এবং তাঁর সাগরেদ বকর। এবং সেটা এত নিপুণ ভাবে করতেন যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হত মীনা’কে। সে-সময়ে এক সাক্ষাৎকারে মীনা বলেন, ‘আমি সূর্য ওঠা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজই করি’। কামালের বাড়ি ‘রেমব্রান্ট’-এ এগারো বছর ছিলেন মীনা। তাঁর মোট ৯৪টি ছবির অন্তত ৫০টি ওই ক’বছরেই শেষ করেন! সেগুলির মধ্য রয়েছে ‘দায়েরা’, ‘দো বিঘা জমিন’, ‘দিল অপনা প্রীত পরাই’, ‘সাহিব, বিবি অউর গুলাম’, ‘ম্যয় চুপ রহুঙ্গি’, ‘আরতি’, ‘দিল এক মন্দির’ প্রভৃতি। এ-সবের মধ্যেই ১৯৫৬ সালে শুরু হয়েছিল বিখ্যাত ‘পাকিজ়া’ ছবির কাজ। বিভিন্ন কারণে ঠেকতে-ঠেকতে ছবিটি সমাপ্ত হয় প্রায় ১৫ বছর পরে।
আরও পড়ুন:
কামালের কাছে মীনা ছিলেন তাঁর ‘স্বপ্নের নারী ও সৃষ্টির প্রেরণা’। তাঁর এই বক্তব্যের যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। তবে, বাস্তবের ঘটনাপ্রবাহ বলে অন্য কথা। বিয়ের আগেই তিনি মীনাকে জানান, তিনি মাহজ়বিন বানোকে বিয়ে করছেন, মীনা কুমারীকে নয়। শর্ত দিয়েছিলেন, রোজ সন্ধে ৬টার মধ্যে নায়িকাকে বাড়ি ফিরতে হবে, স্টুডিয়োয় মেকআপ রুমের দরজা বন্ধ রাখা যাবে না, নিজের গাড়িতে স্টুডিয়োয় যাওয়া-আসা করবেন, কোনও সহ-অভিনেতাকে লিফ্ট দিতে পারবেন না, ইত্যাদি! কামাল-পুত্র তাজদিরের বক্তব্য, ‘ছোটি আম্মি বিয়ের আগে সব শর্ত মেনে নিলেও সেগুলি গ্রাহ্য করতেন না’।
কামাল আমরোহি ও মীনা কুমারীর ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাতের শিকড় সম্ভবত কোথায় ছিল, সে সম্পর্কে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। মুম্বইয়ের ইরোস সিনেমায় ‘সাহিব, বিবি অউর গুলাম’-এর প্রিমিয়ার শো-য়ের আয়োজন করেছিলেন সোহরাব মোদী। সেখানে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের সঙ্গে আমরোহি দম্পতির পরিচয় করাতে গিয়ে সোহরাব বলেন, ‘ইনি প্রখ্যাত অভিনেত্রী মীনা কুমারী, আর উনি ওঁর স্বামী কামাল আমরোহি’। শুনে কামাল রাগে ফেটে পড়েন। বলেন, ‘আমি কামাল আমরোহি, আর ইনি আমার স্ত্রী, প্রখ্যাত অভিনেত্রী মীনা কুমারী’। কথাগুলো ছুড়ে দিয়েই তিনি হল ছেড়ে বেরিয়ে যান।
কামাল আমরোহি ও মীনার দাম্পত্য-দ্বৈরথ যে প্রায়শই শারীরিক নিগ্রহের পর্যায়ে পৌঁছত, সে-কথার উল্লেখ অনেকেই করেছেন। মীনার মৃত্যুর পরে নার্গিস দত্ত (যাঁকে মীনা ডাকতেন বা’জি অর্থাৎ দিদি বলে) ‘মওত মুবারক হো, মীনা’ নামে খোলা চিঠি লেখেন একটি উর্দু পত্রিকায়। তার অংশবিশেষ এই রকম— (মাদ্রাজে ‘ম্যয় চুপ রহুঙ্গি’ ছবির) শুটিং চলাকালীন এক দিন রাতে মীনাকে দেখি বাগানে বসে হাঁপাচ্ছে। বললাম, ‘এত ধকল যাচ্ছে, একটু বিশ্রাম নাও না কেন?’ মীনা বললে, ‘বিশ্রাম আমার ভাগ্যে নেই বা’জি। যেদিন নেব, একেবারেই নেব’। সেদিন রাতে ওঁর ঘরে ধস্তাধস্তির আওয়াজ পাই। পরদিন সকালে দেখি মীনার চোখ-মুখ ফুলে রয়েছে। কামালের সেক্রেটারি বকরকে বলি, ‘তোমরা মীনাকে মারতে চাইছ কেন? তোমাদের পেট ভরাতে মেয়েটা তো প্রাণপাত খাটছে। আর কতদিন ও তোমাদের খাওয়াবে!’ বকর জবাব দিয়েছিল, ‘সঠিক সময় এলেই আমরা ওকে বিশ্রাম দেব’। আব্রার আলভির স্মৃতিকথা ‘টেন ইয়ার্স উইথ গুরু দত্ত’-তেও একই বক্তব্য পড়ি। ১৯৬৪ সালের ৫ মার্চ এগারো বছরের দাম্পত্য চুকিয়ে স্বামীর বাড়ি বরাবরের মতো ছেড়ে যান মীনা। তখন থেকেই বাড়তে থাকে মীনা কুমারীর মদ্যপান। এ নিয়ে নার্গিসের স্মৃতি — ‘মীনা তখন খুব অসুস্থ। এক দিন ওঁকে দেখতে হাসপাতালে যাই। বলি, ‘যে মুক্তি চেয়েছিলে, এখন তো পেয়েছ। এখন এ ভাবে নিজেকে শেষ করার মানে কী?’ মীনা জবাব দিলেন, ‘আমারও তো সহ্যের সীমা আছে বা’জি। কোন সাহসে বকর আমার গায়ে হাত তোলে! কামাল সাহেব সব জেনেও চুপ করে রয়েছেন’। কামাল আমরোহির পরিবার অবশ্য বার বার দাবি করেছে, এ-সব অভিযোগ অসত্য।
‘ফুল অউর পাত্থর’ ছবিতে ধর্মেন্দ্র ও মীনা কুমারী। ছবি: সংগৃহীত।
কামাল আমরোহির কক্ষপথ থেকে নিজেকে বিচ্যুত করলেও তাঁর স্বপ্নের পুরুষটিকে কোনওদিনই ভুলতে পারেননি মীনা। তবে, কামালের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পরে তাঁর জীবনে এসেছিলেন ধর্মেন্দ্র। উল্লেখ্য, রাজেন্দ্র কুমার, রাজ কুমার ও ধর্মেন্দ্রর অভিনেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল মীনার। সে আমলে তাঁর অভিনয়ের যশ ও প্রতিপত্তি এমন জায়গায় ছিল যে, বলা হত মীনা কুমারী চাইলে কোনও তারকাকে তৈরি করতে বা ভেঙে দিতে পারতেন। কিন্তু মীনা কখনওই ক্ষতি করেননি। জুনিয়রদের সহমর্মী সহযোগীর মতো হাতে ধরে তৈরি করে দিতেন। নার্গিসের কথায়, ‘ধর্মেন্দ্রকে পাগলের মতো ভালবেসেছিল মীনা। কিন্তু ওঁদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয় এবং ধর্মেন্দ্র মীনাকে ছেড়ে যান। ছেড়ে যান এমনই একটা সময়ে, যখন মীনার বোধহয় সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল তাঁকেই’!
১৯৭১ সালে মুক্তি পায় গুলজারের ‘মেরে অপনে’। পরের বছর, ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় কামাল আমরোহির ‘পাকিজ়া’। নার্গিস ও সুনীল দত্তের সনির্বন্ধ অনুরোধে অসুস্থ, অশক্ত শরীরে ছবিটি শেষ করতে রাজি হন মীনা। শোনা যায়, ওই ছবির সূত্র ধরেই আবার মীনার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়তে চেয়েছিলেন কামাল। কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রথমে স্তিমিত হলেও কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আশ্চর্য জনপ্রিয়তা পায় ‘পাকিজ়া’। ‘মহল’-এর প্রায় তিন দশক পরে পরিচালক কামাল আমরোহিকে শেষ বারের মতো খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়ে ওই বছরই ৩১ মার্চ হাসপাতালে নিঃসঙ্গ, কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান ‘সাহিবজানের’ দেউলিয়া হয়ে যাওয়া রূপকার।
আজ মীনা কুমারীর ৯২তম জন্মবার্ষিকীতে মনে হয় বিষাদবিধুর, অবসাদখিন্ন বিপন্নতা যুঝতে সম্ভবত প্রেমকেই আশ্রয় করতে চেয়েছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘ট্র্যাজেডি কুইন’। রক্তমাংসের প্রেমিকের মধ্যে দিয়ে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন তাঁর একান্ত প্রেমের বিমূর্ত ধারণাকে। ট্র্যাজেডি কি সেটাই? না হলে কেনই বা চোখ আটকে যায় ‘পেয়ার এক খোয়াব থা’ নামে তাঁরই একটি কবিতার এই পংক্তিগুলিতে—
‘ওয়ক্ত নে ছিন লিয়া হৌসলা-এ-জবৎ-এ-সিতম
অব তো হর হাদিসা-এ-গম পে তড়প উঠতা হ্যয় দিল’
(সময় ছিনিয়ে নিয়েছে নিষ্ঠুরতা বরদাস্ত করার সাহসটুকু, এখন কোনও দুঃখগাথা শুনলে হৃদয় কেবলই কেঁপে ওঠে)
সূত্র: ‘মীনা কুমারী: দ্য ক্লাসিক বায়োগ্রাফি’, বিনোদ মেহতা; ‘মীনা কুমারী: দর্দ কি খুলি কিতাব’, নরেন্দ্র রাজগুরু; ‘ইয়ে উন দিনোঁ কা বাত হ্যয়: উর্দু মেমোয়ার্স অফ সিনেমা লেজেন্ডস, ইয়াসির আব্বাসি; ‘টেন ইয়ার্স উইথ গুরু দত্ত: আব্রার আলভি’জ জার্নি’, সত্য সারন; ‘তনহা চাঁদ’, মীনা কুমারী, সম্পাদনা গুলজ়ার, ‘মীনা কুমারী কি শায়েরী’, মীনা কুমারী, সম্পাদনা গুলজ়ার।