Advertisement
E-Paper

উত্তমের আকাশে ডানা মেললেন সুপ্রিয়াও

সন্ধের রবীন্দ্রসদনে পাশাপাশি দু’টো ছবি থেকে সুপ্রিয়া হাসছেন। একটা রঙিন, তুলনায় সাম্প্রতিক। অন্যটা সাদা-কালো। সেই সময়কার, যখন তিনি টালিগঞ্জের ডাকসাইটে সুন্দরী নায়িকা। ওই ছবিটার সামনেই শায়িত তাঁর নশ্বর দেহ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৯:০৮
‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সুপ্রিয়া। —ফাইল চিত্র।

‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সুপ্রিয়া। —ফাইল চিত্র।

চলে গেলেন সুপ্রিয়া দেবী। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে ওঠার কিছু ক্ষণের মধ্যেই বাথরুমে গিয়ে আচমকা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের এই দিকপাল অভিনেত্রী। গৃহচিকিত্সক আসার আগেই সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ সব শেষ। পাশে তখন একমাত্র মেয়ে সোমা। আর ছিল পোষা সারমেয় কোকো। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিত্সক। দীর্ঘ দিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর সময় সুপ্রিয়া দেবীর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।

বাংলা সিনেমায় মহানায়ক উত্তমকুমারকে ঘিরে যে নায়িকাবৃত্ত, তার প্রথম দুই নাম অবশ্যই সুচিত্রা সেন এবং সুপ্রিয়া দেবী। প্রায় পাশাপাশি উচ্চারিত হতে পারে মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের নামও। তবে এঁদের মধ্যে সুপ্রিয়াই নায়ক উত্তমের পাশাপাশি একান্ত আপন করে পেয়েছিলেন ব্যক্তি উত্তমকে। উত্তম-সুপ্রিয়ার সম্পর্ক একটা সময় বাংলা সিনেমা জগতের ‘হট টপিক’ ছিল। উত্তমের মৃত্যু সম্ভবত তাঁর মতো করে আর কাউকে নিঃসঙ্গ করেনি। তার পর প্রায় ৩৮ বছর ধরে তিনি যে ভাবেই থাকুন, উত্তমের স্মৃতি জড়িয়ে ছিল সব সময়। কথায়-বার্তায়, আলাপ-আলোচনায় বার বার তাঁর মুখে ফিরে ফিরে আসত ‘তোমাদের দাদা’র কথা।

সুপ্রিয়া দেবীর প্রয়াণে বাংলা ছবির আর এক অধ্যায় শেষ হয়ে গেল। সোনার হরিণ, শুন বরনারী, উত্তরায়ন, সূর্য্যশিখা, সবরমতী, মন নিয়ে-র মতো বহু ছবিতে উত্তমকুমারের বিপরীতে মুখ্য ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। ছয়ের দশকের শেষের দিক থেকে পরবর্তী এক দশকে বেশির ভাগ ছবিতেই উত্তমকুমারের নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন তিনি। তবে তাঁর অভিনয় দক্ষতার সবচেয়ে আলোচিত দুই ছবি অবশ্যই ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘কোমল গান্ধার’। মেঘে ঢাকা তারায় সুপ্রিয়ার ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই’-এর আর্তি আজকের প্রজন্মকেও সমান ভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ২০১১ সালে বঙ্গবিভূষণ এবং ২০১৪-এ পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করা হয় তাঁকে।

আরও পড়ুন, ‘দীর্ঘ দিনের বন্ধুকে হারালাম’

তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়াতেই ভিড় জমতে শুরু করে ৩২ নম্বর বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় চলে এসেছিলেন আগেই। আসেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সাংসদ মুনমুন সেন, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা। প্রয়াত অভিনেত্রীর বাড়িতে এসে তাঁর মেয়ে সোমার সঙ্গে শেষকৃত্য নিয়ে আলোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বলেন, “বাংলা চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। শেষ হল উত্তম অধ্যায়েরও।” তার পরে জানান, বিকেল তিনটে থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত মরদেহ রবীন্দ্রসদনে শায়িত থাকবে। বিকেলে মুখ্যমন্ত্রীও রবীন্দ্রসদনে যান, সেখান থেকে শ্মশানে।

সন্ধের রবীন্দ্রসদনে পাশাপাশি দু’টো ছবি থেকে সুপ্রিয়া হাসছেন। একটা রঙিন, তুলনায় সাম্প্রতিক। অন্যটা সাদা-কালো। সেই সময়কার, যখন তিনি টালিগঞ্জের ডাকসাইটে সুন্দরী নায়িকা। ওই ছবিটার সামনেই শায়িত তাঁর নশ্বর দেহ। চারপাশে থমথমে অজস্র মুখ। একটু পরেই শববাহী গাড়ি আর মিছিল তাঁকে পৌঁছে দেয় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। আকাশে গর্জে ওঠে রাজ্য পুলিশের বন্দুক। সুপ্রিয়া দেবীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘৬০ বছরের বন্ধুত্বে ছেদ পড়ল।’’ শোকস্তব্ধ পরিচালক তরুণ মজুমদারও।

১৯৩৩ সালের ৮ জানুয়ারি তৎকালীন বর্মার মিতকিনায় জন্ম কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাবা ছিলেন আইনজীবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় চলে আসা। ১৯৫২ সালে উত্তমকুমারের সঙ্গে ‘বসু পরিবার’ ছবি দিয়ে শুরু। ১৯৫৯-এ উত্তমের সঙ্গেই ‘সোনার হরিণ’ হিট। ইতিমধ্যে কৃষ্ণা হয়ে উঠলেন সুপ্রিয়া, বিবাহসূত্রে চৌধুরী। ১৯৫৪-এ বিশ্বনাথ চৌধুরীকে বিয়ে করেন অভিনেত্রী। তাঁদের কন্যা সন্তান সোমা রয়েছেন। তবে বিশ্বনাথের সঙ্গে দাম্পত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি সুপ্রিয়ার। মাত্র সাত বছর বয়সে অভিনয়ের জগতে পা রাখেন তিনি। দু’টি নাটকে অভিনয় করেছিলেন, তাঁর বাবার নির্দেশনায়। ছোট থেকে নাচ খুব ভালবাসতেন অভিনেত্রী। কলকাতায় আসার পরও নাচ চালিয়ে যান তিনি।

১৯৬০-এর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সুপ্রিয়াকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। ১৯৬০-৬১ সালে পর পর দু’টো বিস্ফোরণ! প্রথমে ‘মেঘে ঢাকা তারা’, তার পর ‘কোমল গান্ধার’। অনেকে বলেন, ঋত্বিককুমার ঘটকের এই দুই ছবিতে সুপ্রিয়া যে পর্যায়ের কাজ করেছেন, জীবনে আর কোনও ছবি না করলেও চলত। সুপ্রিয়া অবশ্য থামেননি। একের পর সফল ছবি দিয়েছেন ইন্ডাস্ট্রিকে— ‘মন নিয়ে’, ‘কাল তুমি আলেয়া’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘চৌরঙ্গী’ থেকে ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘বাঘবন্দি খেলা’। কিশোর কুমারের ‘দূর গগন কি ছাঁও মে’-তেও তিনি। নব্বইয়ের দশকে মেগা সিরিয়াল ‘জননী’। সেখানেও হিট। আর ছিল বিখ্যাত ‘বেণুদির রান্না’। রান্না নিয়ে তাঁর শো, লেখালেখির কথাও ঘুরছিল এ দিনও।


সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে রয়েছেন প্রসেনজিত্, মুনমুন সেন, রাইমা সেন, গৌতম ঘোষ প্রমুখ।ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

গত ৮ তারিখেই জন্মদিনে বাড়িতে কেক কেটেছিলেন সুপ্রিয়া। অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু রাত পর্যন্ত দুঃসংবাদটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই লেগেছে অনেকের। সন্ধ্যায় আবার দুঃসংবাদ। টেনিদার ‘চারমূর্তি’, ‘ধন্যি মেয়ে’-র মতো ছবির অভিনেতা শম্ভু ভট্টাচার্য প্রয়াত।

‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা তখন এ সব থেকে অনেক দূরে।


রবীন্দ্রসদনে শায়িত সুপ্রিয়া দেবীর মরদেহ। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

Supriya Devi Tollywood Bengali Actress Actress সুপ্রিয়া দেবী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy