Advertisement
E-Paper

জোলি কে পিছে

পিঠের তিল? ছড়ানো ঠোঁটের লাস্য? কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে নিরীহ মধ্যবিত্ত বাঙালি? ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালের দিন লন্ডনের স্পোর্টস বার-এ হঠাৎ অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। বাকরুদ্ধ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।লন্ডন। ১৩ জুলাই। বিকেল বা সন্ধে ৭টা। তখনও সেন্ট পলস্ চার্চের গম্বুজে রোদ্দুর। আমার গাড়ির নাইজিরিয়ান চালক ভাঙা ইংরেজিতে আমায় স্পষ্ট জানিয়ে দিল আজ এখানকার সাহেবরা আদৌ আর্জেন্তিনাকে সমর্থন করবে না।

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৪ ০০:০০

লন্ডন। ১৩ জুলাই। বিকেল বা সন্ধে ৭টা। তখনও সেন্ট পলস্ চার্চের গম্বুজে রোদ্দুর। আমার গাড়ির নাইজিরিয়ান চালক ভাঙা ইংরেজিতে আমায় স্পষ্ট জানিয়ে দিল আজ এখানকার সাহেবরা আদৌ আর্জেন্তিনাকে সমর্থন করবে না। জার্মানি ওদের প্রিয় না হলেও, ওই ‘হ্যান্ডস্ অব গড’য়ের রাগ সাহেবরা আজও ভোলেনি। কলকাতার বেশ ক’জন বন্ধু আমাকে পই পই করে বলে দিয়েছিল আমি যেন বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালটা একা হোটেল রুমে বসে না দেখে, একটা ব্রিটিশ স্পোর্টস পাবে গিয়ে দেখি।

হাতে তখনও এক ঘণ্টা। লন্ডনের ৮টায় কিক অফ। একটাই আশঙ্কা মনে ঢুকল, ওদের সঙ্গে খেলা দেখতে বসে মেসিকে নিয়ে চিৎকার করে বিপদে না পড়ি! এর চেয়ে বাড়ির চেনা লাকি সোফায় বসে সপরিবার ম্যাচ দেখা অনেক শান্তির ছিল! রাস্তাঘাটেও দু’-একটা মেসি বা মারাদোনার জার্সি ছাড়া চারপাশে শুধুই জার্মান জার্সি! হাওয়া গরম। ঘরে ঢুকে চটপট পোশাক বদলে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেলটা বিশাল আয়তনের, নানা দিক থেকে ঢোকা ও বাইরে যাওয়ার পথ। ১৪ তলা এই ভুলভুলাইয়ার একতলাতেও একটা স্পোর্টসবার রয়েছে। সেখানে দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো মারাদোনার সই করা আসল জার্সি! তার মানে ওই পাবের কর্তা আর্জেন্তিনার পক্ষে হতে বাধ্য। তা ছাড়া নিজের হোটেল আমার। বেগতিক বুঝলে সোজা ডাগ আউটে ঢুকে যাব।

বার কাউন্টার ছাড়া প্রায় সব টেবিল ভর্তি। নানা দেশের মানুষ সেখানে। একটু সজাগ হতেই বুঝতে পারলাম ওই নাইজিরিয়ান ড্রাইভার ভদ্রলোক সম্পূর্ণ সঠিক ছিলেন না। এই স্পোর্টস বারে আমি ছাড়াও অনেক মেসি ভক্ত। বার কাউন্টারের গা ঘেঁষে একটা বার স্টুলে বসে পড়লাম। যতই ভিড় বাড়ুক আমাকে আর পিছোতে হবে না। মোট ২০টার মতো বড় বড় টিভি চারপাশে। গমগম করছে ভিতরটা, মনে হচ্ছে মাঠেই বসে আছি। ব্রাজিলের ৭-১ হারার ভয়টা সব আর্জেন্টিনা ভক্তকেই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তবু মন বলছে আজ খালি হাতে ফিরব না।

আটটা। তখনও বাইরে ভরপুর আলো। তবে লন্ডন শহরের রাস্তায় একেবারে বাংলা বন্ধের পরিবেশ। একটা মানুষেরও দেখা নেই। গাড়িও নেই। যেন ঝড় আসবার আগে সব গাছপালা ঝিম্ মেরে থমকে আছে। খেলা শুরু।

এক বয়স্ক সাহেব ধূমপান করতে গিয়ে নিজের বার স্টুলটা খুইয়েছেন আমার ঠিক পাশেই। বেশ বিরক্ত তিনি। এত মানুষ দাঁড়িয়ে যে কেউ একটু উঠলেই মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো চেয়ার, স্টুল বা সোফা গায়েব হয়ে যাচ্ছে। সাহেবরা আবার জটায়ুর মতো লাফিয়ে, তালি বাজিয়ে বলে না, ‘এটা আমার!’

আমি ভারতীয় ভদ্রতায় বৃদ্ধকে আমার স্টুলটা দিলাম বসতে। খুব খুশি হয়ে বসে খেলা দেখছেন উনি আমার পাশেই। প্রথম ১৫-২০ মিনিট যা হওয়ার তাই হল পানীয়, চিৎকার, অফসাইড, ফাউল, মিসপাস, হাসিঠাট্টা এই সব।

তখনই হঠাৎ পাবে ঢুকলেন সাদা শর্ট ফ্রক, খোলা চুল, সুগন্ধি অথচ একবিন্দু মেক আপ না করা এক মহিলা ও তার সঙ্গে জিপিওর থামগুলোর মতো বড় বড় দুই পুরুষ! আমিও যথেষ্ট লম্বা, ছয় ফুট। আমার ওজন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সচেতন। সেই আমার পাশেও ওই দুই জগাই মাধাই দৈত্য! ওরা মহিলার দু’পাশে দাঁড়াল। ঠিক আমার আর আমার ওই বৃদ্ধ সাহেব পাব-বন্ধুর সামনে। মহিলা আবার আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আশপাশটা মেপে নিলেন! ঠিক আমার দু-তিন ফুট সামনে। মাঝে অচেনা একটা গন্ধ ছাড়া আর কোনও দেওয়াল, আড়াল নেই। নিমেষে ওই স্পোর্টস বারের ২০টা বড় বড় টিভি আমার কাছে অবান্তর হয়ে গেল। কী আর খেলা দেখব! কাকে দেখব!

আমার সামনের মহিলা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি! হ্যাঁ! অ্যাঞ্জেলিনা জোলি! এক ফোঁটাও ভুল দেখছি না আমি। ঈশ্বর ওর মতো প্রতিভা হয়তো অনেক তৈরি করেছেন বা করবেন। ওর চেয়ে হাজারো গুণ সুন্দরীও তৈরি করেছেন বা করবেন। কিন্তু ওই সম্মোহনী ঠোঁট আর গভীর চোখ আর একটাও তৈরি করবেন না। সাহেবরা বড্ড ঠান্ডা।

সব্বাই একবার ওকে দেখল কিন্তু আর দ্বিতীয়বার ঘুরে তাকিয়ে বা মোবাইলে ছবি তুলে ওকে বিব্রত করল না। যেন হতেই পারে এমনটা। আমি আদৌ সাহেব নই। আমার দেশে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দেখলে কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে সম্ভ্রান্ত অধ্যাপকও দাঁত বের করে একটা ছবি তুলবেনই। আমরা আবেগ হ্যাংলা! হতে পারে কলকাতায় আমিও পরিচিত মুখ। আমিও অটোগ্রাফ দিই। আমার সঙ্গেও লোকে গা ঠেকিয়ে ছবি তোলে। কিন্তু আমি তো ভারতীয়। আমি কী করে মেনে নেব তিন ফুটের মধ্যে দাঁড়ানো অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে! নিঃশ্বাস অনিয়মিত হয়ে যাওয়াটা একটা অসম্ভব সুস্থতার লক্ষণ এবং আমার তাই হল।

বৃদ্ধ সাহেবের খারাপ লাগছিল জোলিদি ওই ভাবে দাঁড়িয়ে...তাই আমার দান করা বারস্টুলটা দেখিয়ে আমার অনুমতি নিলেন, “ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড...!” আমি তো নিমেষে রাজি। কলকাতার অভিনেত্রী হলেও ভদ্রতা করে মহিলাদের চেয়ার ছেড়ে দেওয়া হয়তো সাহেবরাই আমাদের শিখিয়েছিল। আমিও তাই করলাম। আমার স্টুলে। আমার বসা স্টুলে। আমার ছেড়ে দেওয়া, অনুমতি দেওয়া বারস্টুলে বসলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি! যেন আমিই বললাম, ‘বসুন অ্যাঞ্জেলিনা...’। উনি ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে বসলেন।

অ্যাঞ্জেলিনা আর আমি দু’জনেই আর্জেন্টিনার সমর্থক! মেসিও সে দিন এমন আমারই মতো ভেবলে গেল! শুধু হেঁটে বেড়ালো আর মিস পাস করতে থাকল!

আমরা দু’জনেই হতাশ হতে থাকলাম খেলা নিয়ে। একসঙ্গে হাততালি দিলাম, একসঙ্গে চিৎকার করলাম অফসাইড গোলে! আর তারপরেই লাইন্সম্যানের ফ্ল্যাগ দেখে আমি আর অ্যাঞ্জেলিনা দু’জনেই কাঁধ ঝুলিয়ে ফেললাম।

ওর কাঁধে সাদা সরু স্ট্র্যাপটার উপর হাল্কা হাল্কা চুল। পিঠে ছোট ছোট দু’-একটা বাদামি তিল। আর বেশি দেখার বা লক্ষ করার সাহস হয়নি, যেই বুঝলাম ওই দু’জন লম্বা লোক আমার দিকে নজর রাখছে। ওরা বডিগার্ড। শুধু পাহারা দেয়। সিনেমার কিছু বোঝে না নিশ্চয়ই। আমি পরিচালক। লন্ডনে বেড়াতে আসিনি। এসেছি ‘অপুর পাঁচালী’র ইউকে প্রিমিয়ারে। তবে? গোত্র যদি মেলাতে হয় জোলিদির তিন ফুটের মধ্যে আমার থাকাটাই স্বাভাবিক। এ কথাটা না বুঝল সে, না বুঝল সাদা পোশাকের বডিগার্ড দু’টো। আমি অচেনা হয়েই ‘জোলিকে পিছে’ দাঁড়িয়ে রইলাম। যাক গে।

খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়িয়ে গেল। অ্যাঞ্জেলিনা আর আমার যৌথ তুকতাকে কোনও লাভ হল না আর্জেন্টিনার। এ বার একটা নতুন কিছু তুক চাই। সবচেয়ে বড় কথা একটু মন দিয়ে বাকি খেলাটা দেখতে চাই। ওকে ফেলে রেখেই, বৃদ্ধ বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে আমি হোটেল রুমে ফিরে গেলাম। ঈশ্বরের দিব্যি একবারও ফিরে তাকাইনি।

লন্ডন। ১৪ জুলাই। রাত বা সন্ধে সাড়ে ৯টা। তখনও বাইরে অনন্ত ম্যাজিক আওয়ার চলছে। এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে দিল্লি ফিরছি আমি। গতকাল ম্যাচে সব খুইয়ে রিক্ত আমি। এ বার ঘরে ফিরতে চাই। যেমন সবাই চায় বাহ্যিক উত্তেজনার শেষে। তখন, ‘থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার...’! আমার বনলতা আমার বাড়িতেই থাকে। তার প্রেমিক আমি। বডিগার্ডও আমি। ফিরছি আমি।

আমার দু’টো সিট ও পাশে ফিরছেন এক কিংবদন্তি! মিলখা সিংহ। সঙ্গে সম্ভবত ওঁর স্ত্রী। লাঠিতে ভর দিয়ে চেয়ারে বসলেন মহিলা। মিলখা সিংহ ওঁর প্রেমিক ও বডিগার্ড। অনেকে ওঁর সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কাউকে ফেরাচ্ছেন না উনি। ভারি গলায় সবাইকেই বলছেন, “গড ব্লেস ইউ, বেটা!” আমি চুপচাপ জানালার বাইরে বাকি লন্ডনটুকু দেখতে দেখতে ভাবছি, মিলখাজি বিশ্বের অনেক দৌড়ে আপনি জিতে ফিরেছেন, কিন্তু আজ লন্ডন-দিল্লি ৮ হাজার ২৬০ কিলোমিটার ম্যারাথনে কিন্তু আমি জিতলাম। কারণ আমার কাছে একটা বাড়তি ট্রফি অ্যাঞ্জেলিনা জোলি...

angelina jolie kaushik gangopadhay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy