Advertisement
E-Paper

স্বাধীনতার ট্রেনে ভগবান নেই, লাস্ট স্টপ ইন্ডিয়া

৮২ বছরের বৃদ্ধ গিনির হাত ধরল ১২ বছরের বালক গিনি। সাক্ষী থাকলেন৮২ বছরের বৃদ্ধ গিনির হাত ধরল ১২ বছরের বালক গিনি। সাক্ষী থাকলেন উজ্জ্বল চক্রবর্তী

উজ্জ্বল চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৭ ২১:১১
শরণার্থীদের নিয়ে ভারতের উদ্দেশে পাকিস্তানি ট্রেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

শরণার্থীদের নিয়ে ভারতের উদ্দেশে পাকিস্তানি ট্রেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

ছোটবেলাটা এখনও যেন আটকে আছে ফ্রেমে। ছবিটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। বয়সের কারণে স্মৃতিও আধা-ঝাপসা। তবু, সেই দিনটার কথা মনে আছে গিনি মেহবুবানির। মা, ছোটভাই আর বোনের সঙ্গে লম্বা একটা রেল সফর— ‘আ ট্রেন টু ইন্ডিয়া’।

ভারত যে দিন স্বাধীন হল, গিনি সে দিন পাকিস্তানে। ঠিক আগের দিনই আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন হয়েছে সে দেশ। গিনির জন্ম অবিভক্ত ভারতের সিন্ধ প্রদেশের হায়দরাবাদে। সালটা মনে পড়লেও তারিখ আর এখন ভাল করে মনে করতে পারেন না বিরাশি বছরের বৃদ্ধ। ভারতের মানচিত্রের পশ্চিম দিকে যে জায়গাটা অনেকটা সিংহের মুখের মতো দেখতে, সেই গুজরাতের কিছুটা উপরের দিকেই হায়দরাবাদ। শহরের হিরাবাদ এলাকায় ছিল গিনিদের বিশাল বাড়ি। কিন্তু, দেশভাগের পর সে সব ছেড়েই মায়ের হাত ধরে ট্রেনে চেপে সোজা কলকাতা।


লিন্ডসে স্ট্রিটে নিজের দোকানে গিনি মেহবুবানিয়া।—নিজস্ব চিত্র।

১৯৪৭-এর অগস্ট। তারিখটা সম্ভবত ১৭। সেই ট্রেনের ঠাসাঠাসি ভিড়টা আজও যেন চোখে স্পষ্ট ভাসে। গেটের হ্যান্ডল ধরে ঝুলছেন অনেকে। ট্রেনের ছাদেও লোক। ভিতরে কোনও মতে জায়গা পেয়েছিলেন গিনিরা। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১২। চিরচেনা হিরাবাদ ছেড়ে মন যেতে চাইছিল না। এর আগে কখনও প্রিয় শহর ছেড়ে কোথাও যায়নি ছোট্ট কিশোর। একরাশ মন খারাপ নিয়ে ট্রেনে উঠেছিল সে। ভাই-বোন আরও ছোট। তবে, মনে একটাই আনন্দ। অনেক দিন পর দাদাকে দেখতে পাবে। বাবা মারা যাওয়ার পর আর তো তার সঙ্গে দেখাই হয়নি!

স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনটা কেমন ছিল? ১৪ অগস্ট সন্ধ্যায় সে সব খুব স্পষ্ট মনে করতে না পারলেও, বিশেষ ওই দিনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল গিনির। ইংরেজিতে তিনি বলছিলেন, ‘‘দাদার কাছে যাচ্ছি, ভাবলেই আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু, কান্না পাচ্ছিল বন্ধু ভগবানের কথা মনে পড়লেই। কোনও দিন ওকে ছেড়ে কোত্থাও যাইনি তো!’’ এ সব ভাবতে ভাবতে ট্রেন কখন ছেড়েছে মনে নেই। হঠাত্ চিত্কার! কারা যেন চেঁচাচ্ছে। গিনির কথায়, ‘‘কোনও মতে জানলা দিয়ে ঝুঁকে দেখলাম, দরজায় ঝোলা কয়েক জনকে কারা যেন টেনেহেঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলের হাতে অস্ত্র। মা দেখে আমাকে ভিতরে টেনে নেন। কিন্তু, তার আগেই রক্তাক্ত সেই দৃশ্য যে আমার মনে গেঁথে গিয়েছে।’’ গিনি কিছুটা থমকালেন। গলাটা ধরে এল যেন! একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘‘রাজস্থান সীমান্ত পেরিয়েছিলাম। কচ্ছ ঘেঁষা কোনও জায়গা। আজ আর মনে নেই।’’

আরও পড়ুন
স্বাধীনতার সকালে পাওয়া দু’টি বিস্কুটই ছিল নিজের অর্জন

কিন্তু, কলকাতা কেন?

নিউ মার্কেটের লিন্ডসে স্ট্রিটে গিনির এখন রমরমা এবং ঝাঁচকচকে ঘড়ির শো-রুম। পুজোর আগে ভরা বাজারে খরিদ্দার সামলাতে সামলাতেই তিনি মনে করছিলেন সব। বললেন, ‘‘বাবা কলকাতায় এসেছিলেন ব্যবসা করতে। সেটা ১৯৪০-এর শুরুর দিক। হগ সাহেবের মার্কেটের কাছেই ঠাকুরদা লীলারামের নামে এই দোকান খুলেছিলেন।’’ বাবার সঙ্গে গিনির বড় দাদাও এখানে থাকতেন। মাঝে মাঝে হিরাবাদ যেতেন বটে। কিন্তু, ১৯৪৪-এ গিনির বাবার ভীষণ জ্বর হয়। সেই জ্বর নিয়েই বাড়িতে ফেরেন। গিনি মনে করতে পারেন, বাবার বিছানার পাশে বসে মায়ের শুশ্রূষা। তিনিও বাবাকে বিস্কুট খাইয়ে দিতেন, মনে আছে। তার পর এক দিন জানা গেল, বাবার নিউমোনিয়া হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রায় বিনা চিকিত্সায় মারা যান ভদ্রলোক। গিনির কথায়, ‘‘বাবা চলে যাওয়ার পর দাদা কলকাতায়। আমরা হায়দরাবাদে। মা তাই ঠিক করলেন, কলকাতায় চলে আসবেন।’’

দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ! রাস্তায় বেরলেই ব্রিটিশ সেনা। সঙ্গে রাজনৈতিক ডামাডোল। ছোট্ট গিনির কথা মনে আছে বৃদ্ধ গিনির, ‘‘জানেন, হিরাবাদের রাস্তা ছিল এক্কেবারে ঢালু। ভগবান আর আমি কেডস পরে সেই ঢালু রাস্তায় ছুটে বেড়াতাম। সেনার লোকজন আমাদের হাতে চকোলেট দিত, মনে আছে। ভগবানকে আজও ভীষণ মিস করি।’’


পঞ্জাব সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের পথে শরণার্থীরা। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

ভগবান কোথায় থাকেন এখন?

বৃদ্ধ গিনির চোখ ছলছল করে উঠল। বললেন, ‘‘জানি না। ওরাও চলে এসেছিল দেশভাগের পর। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ওর এক দাদা খুঁজে পেতে আমার এই দোকানে এসেছিলেন। ফোন নম্বর নিয়ে গিয়েছিলেন। এক-দু’বার কথাও হয় ভগবানের সঙ্গে। ওরা তখন সদ্য বম্বেতে এসেছে। তার পর আর কোনও যোগাযোগ হয়নি। জানি না বেঁচে আছে কি না!’’

কলকাতায় চলে আসার পর আর পাকিস্তানে যাননি কখনও? জন্মভূমির টানে? গিনি জানালেন, সেটাও প্রায় ষাট বছর হয়ে গিয়েছে। পাসপোর্ট করে এক বারই কলকাতার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে করাচি গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে খুব একটা দূরে নয় হায়দরাবাদ। কিন্তু, যে এলাকায় তাঁদের বাড়ি ছিল, সেখানে যেতে পারেননি। প্রশাসনের লোকজনই বারণ করেছিল। পুরনো কিছু বন্ধুর নাম ওই বয়সে মনে ছিল, তাঁদেরও খোঁজ করেন। কিন্তু, দেখা মেলেনি। এক রাশ খারাপ লাগা নিয়ে ফের ফিরে এসেছিলেন এই কলকাতায়। আর কখনও যাননি।

আরও পড়ুন
‘এই স্বাধীনতা কীসের স্বাধীনতা?’

বিরাশি বছরের গিনি এখনও ১৫ অগস্ট এলে আবেগে ডুবে যান। মনে পড়ে যায় জন্মভূমির কথা। জন্মভূমি ছেড়ে আসার কথা। বন্ধুদের কথা। ছোটবেলার কথা। বিশেষ করে ভগবানের কথা। কিন্তু, দু’দেশের স্বাধীনতা তাঁকেও যে অন্য এক স্বাধীনতা দিয়েছিল। নিজের মতো করে মায়ের সঙ্গে নতুন শহরে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। এই শহরে না এলে যে জীবনটা এ ভাবে ফুরফুরে করে কাটানোই যেত না!

স্বাধীনতার এ গিনির একটা দিক ঝকঝকে উজ্জ্বল, আর এক দিকে টলটলে জল!

Independence Day Indian Independence Day 15th August India Pakistan ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবস
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy