Advertisement
E-Paper

স্বাধীন দেশেও বাড়ির বৌ হতে আপস করতে হয়

সংসারে স্বাধীনতা তা হলে কি? ছোট আপস না কি স্বাধীন ইচ্ছেকে বিকিয়ে দেওয়া! অথচ সংসার-পরিবারই তো শিশুর বেড়ে ওঠার প্রথম সহজ পাঠ। সেই শিশুই তো স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক। তার শেখার উপরেই নির্ভর করবে আগামী সমাজের মনন।

মৌমিতা করগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:৫৯
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

বিয়ের পরপরই গিয়েছিলাম ছোটবেলার বন্ধুর বাড়িতে। ভূরিভোজ সেরে দেখি ঘড়ির কাঁটা ১০টা ছুঁইছুঁই, আর গল্প বাকি এক সমুদ্র। বলে দিলাম, আজ ফিরব না। রাতভর গল্প করব। বেজায় খুশি হয়েও হঠাৎই সতর্ক বন্ধু, ‘‘বরের অনুমতি নিয়েছিস?’ এক রাত হঠাৎ থেকে যাওয়ার জন্য দশ বছরের পুরনো প্রেমিক তথা দিন দশেকের পুরনো বরের অনুমতি নেব কেন মাথায় ঢোকেনি! সুগৃহিণী বন্ধু জানাল, প্রেম আর বিয়ে আলাদা। বুঝেছিলাম, ওর অভিজ্ঞতায় বিয়ে মানে আসলে স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলা প্রেম।

এখনও শহরের কোনও না কোনও গৃহকোণে এমনই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার স্বাধীনতাটুকুতেই খুশি হয়ে কাটিয়ে দেয় বহু মেয়ে। ‘‘ছোট টপ পরতে বারণ করেছে কিন্তু লং কুর্তি দিয়ে জিন্‌স পরলে শ্বশুরবাড়িতে কিচ্ছু বলে না।’’— বলেছিল পেশায় স্কুলশিক্ষিকা এক বন্ধু। তুই তো অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন, ইচ্ছে করে না নিজের শর্তে বাঁচতে? হেসে বলেছিল, ‘‘স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিককেও বাড়ির বৌ হতে গেলে এটুকু আপস করতেই হয়।’’

সংসারে স্বাধীনতা তা হলে কি? ছোট আপস না কি স্বাধীন ইচ্ছেকে বিকিয়ে দেওয়া! অথচ সংসার-পরিবারই শিশুর বেড়ে ওঠার প্রথম সহজ পাঠ। সেই শিশুর শেখার উপরেই নির্ভর করবে আগামী সমাজের মনন।

আর এক পাড়াতুতো পিসিকে দেখেছিলাম গোটা জীবন স্বামীর প্রবল দাপটের ছায়ায় কাটাতে। স্বামীর মৃত্যুর পরে এক দিন হঠাৎ দেখা পাড়ার ফুচকাওয়ালার সামনে। বলেছিলেন, ‘‘তোর পিসেমশাই এ সব পছন্দ করতেন না, তাই আসতাম না। এখন মাঝে মাঝে আসি।’’ বিটনুন আর তেঁতুল গোলা চাখা তৃপ্তি জানান দিচ্ছিল তাঁর স্বাধীনতা। সে দিনের অভিজ্ঞতা শিখিয়েছিল, মৃত্যুতে সব শেষ হয় না। কোনও কোনও মৃত্যু কি স্বাধীনতার জন্ম দিয়ে যায়?

আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তনীকে তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে পিটিয়ে মারার খবরটা শুনেছিলাম কিছু দিন আগে। সকলে আফশোস করেছিল, ‘‘কেন আগে জানাল না।’’ পরে শুনেছিলাম মেয়েটা ওর সবথেকে নিরাপদ জায়গা, মা-কে নিয়মিত বেড়ে চলা অত্যাচারের কথা জানিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘একটু মানিয়ে নে।’’ ভরসার মানুষটাই আশ্রয় দিতে ভয় পেয়েছিলেন। আর কাকেই বা জানাত মেয়েটা। আজীবন এ অপরাধের দায় বইতে হবে জেনেও মা পারেননি। ভাইদের সংসারে বিয়ে-থা হওয়া মেয়েকে ফিরিয়ে আনার স্বাধীনতা কোথায় মধ্যবিত্ত প্রৌঢ়া মায়ের?

বছর দু’য়েক আগে প্রায় দিনই চা খেতে যেতাম গল্ফ গ্রিনের একটা দোকানে। আপাত শান্ত জায়গাটা মুখর হয়ে থাকত চা-দিদি’র দু’বছরের ছেলে আর বেড়ালছানার দৌরাত্ম্যে। অনেক দিন পরে হঠাৎ গত সপ্তাহে গিয়ে দেখি, ঝুপড়ির চাল বেআব্রু। ছেঁড়া তোশকের মাঝে সংসার রেখে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধছেন দিদি। চেনা মুখ দেখে ম্লান হেসে বললেন, ‘‘এখানে আর চা হবে না। তেত্রিশ তলা ফ্ল্যাট উঠবে। আমাদের উঠে যেতে বলেছে।’’ ওইটুকু শিশু নিয়ে অচেনা শহরে একা মহিলা কোথায় যাবেন? মধ্যবিত্ত ভীরুতা নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকাই। সে নিশ্চিন্তে মায়ের আঁচলের শেষ প্রান্ত খুঁটছে। বেড়ালও পরমানন্দে গা চাটছে। জিজ্ঞাসা করি, ‘‘কোথায় যাবে, বাড়িতে?’’ দিদি বলেন, ‘‘বাড়ি তো নাই গো, স্বামী অন্য মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে পয়সা ওড়াত। যে দিন ছেড়ে এসেছি, সে দিন থেকে নিজের রোজগারে খাই। ছেলে আর বেড়ালের দু’বেলা ভাতের ভারও আমার। তিনটে তো পেট, ফের কোথাও একটা দোকান দিয়ে ঠিক চালিয়ে নেব।’’

চোখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে চা-দিদি’র।

Independence Day Women Marriage
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy