Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নেশন তৈরি করতে গেলেই বিপদ

এমনই চেতাবনি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ দেশে নানা ভাষা ও ধর্মের ঐক্য তাঁর অজানা ছিল না। সেই বৈচিত্র ছেঁটে, আজ এক দেশ এক সংস্কৃতির ছাঁচে দেশ গড়তে চাইছেন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়এমনই চেতাবনি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ দেশে নানা ভাষা ও ধর্মের ঐক্য তাঁর অজানা ছিল না। সেই বৈচিত্র ছেঁটে, আজ এক দেশ এক সংস্কৃতির ছাঁচে দেশ গড়তে চাইছেন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৭ ০৮:২০
Share: Save:

আমি যদি আরএসএস-এর মতাদর্শে বিশ্বাস করতাম, আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকত, তা হলে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘লেখাপত্র’ কিছুতেই সইতে পারতাম না। রবীন্দ্র-রচনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতাম। যিনি লিখেছিলেন, ‘ওদের মদের ভাঁড়ার, অস্ত্রশালা আর মন্দির একেবারে গায়ে গায়ে’, লিখেছিলেন, ‘যে রশিতে এই চাবুক তৈরি সেই রশির সুতো দিয়েই ওদের গোঁসাইয়ের জপমালা তৈরি’, সেই রবীন্দ্রনাথকে আরএসএস-এর আদর্শ কর্মীরা ছেড়ে দেবে কেন? রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র নিয়ে তাই কথা উঠছে। এ মুহূর্তে হিন্দুভারতের গর্বের ধুয়ো তুলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুকে হিন্দুত্বের একরঙা চেহারায় যাঁরা মাতিয়ে তুলতে চাইছেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা তাঁদের সহ্য হওয়ার কথা নয়।

রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকে জন্মেছিলেন। ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ নামের দীর্ঘ কবিতাটিতে কিশোর রবি লিখেছিলেন, ‘শুনেছি আবার, শুনেছি আবার,/ রাম রঘুপতি লয়ে রাজ্যভার,/ শাসিতেন হায় এ ভারতভূমি,/ আর কি সে-দিন আসিবে ফিরে!’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর কিশোরবেলায় লেখা এই উনিশ শতকীয় কবিতার জগতেই থেমে গেলে রামনাদে জয়ধ্বনি দিতে দিতে সঙ্ঘ পরিবার অবশ্যই এই বাঙালি কবিকে ‘আ গলে লগ যা’ বলে গ্রহণ করতেন। রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকেরও মানুষ। উনিশ শতকের ভুলগুলিকে, নিজের পিছুটানকে সংশোধন করতে করতে এগিয়েছেন।

আরও পড়ুন: স্বাধীনতার সকালে পাওয়া দু’টি বিস্কুটই ছিল নিজের অর্জন

বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাজাত্যবোধের আবেগ থেকে ইউরোপের নেশনকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের মডেলকে কেবল সমালোচনা করলেই হবে না, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে নেশন নির্মাণের খোয়াবকে প্রশ্ন করতে হবে। বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ এক দিকে যেমন ইংরেজ শাসকদের আধিপত্যকামী নিষ্ঠুরতার তীব্র সমালোচনা করেছেন তেমনি ভারতীয় নেশন-নির্মাণের যুক্তিকেও চোখবন্ধ সমর্থন করেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যার পর সেই জঘন্য হত্যার নিন্দা করেছেন, নাইটহুড ত্যাগ করেছেন। তাঁর ইংরেজিতে লেখা ‘ন্যাশনালিজম’ নামের লেখায় নেশন নামের প্রকল্পকেই বাতিল করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে নেশন হল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, জনগণকে যান্ত্রিক ভাবে এক দিকে পরিচালনকারী, লাভের যুক্তিতে গড়ে ওঠা একটি তৈরি-করা সংগঠন। এই সংগঠন ইউরোপে হানাহানির কারণ, ভারতেও নেশনের আদর্শে যদি কোনও সংগঠন গড়ে তোলার কথা ভাবা হয় তা হলে বিপদ অনিবার্য। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ভারত নামের ভূখণ্ডটিতে নানা ভাষা ও নানা ধর্মের সমাহার। ইউরোপের আদলে লাভদায়ক নেশন গড়ে তুলতে চাইলে নানা রকম ধর্ম ও ভাষার ওপর হাত পড়বে। বৈচিত্রের ডালপালা ছেঁটে দিলেই তো লাভজনক কেজো ডান্ডা তৈরি করা সম্ভব। এই যুক্তিতেই হিন্দি ভাষা থেকে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের ডালপালা ছেঁটে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছেন সঙ্ঘবাদীরা। এক দেশ এক সংস্কৃতির নামে নানা মতকে বাতিল করতে চাইছেন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে রাতারাতিই নানা নাটক। এই যাঁদের মনোভাব তাঁরা তো রবীন্দ্রনাথের লেখাকে মুছে ফেলতে পারলেই বাঁচেন।

রবীন্দ্রনাথ শুধু যে রাষ্ট্র নামের সংগঠনের বিপক্ষে তা-ই নয়, একমাত্রিক ধর্মীয় সংগঠনেরও তিনি প্রতিপক্ষ। বিনায়ক দামোদর সাভারকর যখন ‘হিন্দুত্ব’ লিখছেন, সেই বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকেই রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’ লিখেছেন। সাভারকর যখন ‘কমন ফাদারল্যান্ড’ ‘কমন ব্লাড’-এর যুক্তিতে ‘হিন্দুত্বের’ নির্মাণ করতে উৎসাহী, তখন রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকে খারাপ গুরুমশাই বলেন, ‘যাতে উত্তরকূটের গৌরবে এরা শিশুকাল হতেই গৌরব করতে শেখে তার কোনো উপলক্ষ্যই বাদ দিতে চাই নে।’ এই গুরুমশাই হালের সঙ্ঘীদের আদি রূপ। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের বিলক্ষণ চিনতেন। ‘কমন ফাদারল্যান্ড’-এর গৌরবে যে গুরুমশাই ছেলেদেরকে গৌরবান্বিত করতে চান সেই গুরুমশাই ‘মুক্তধারা’ নাটকে পরাজিত।

আরও পড়ুন: দেখুন স্বাধীনতার প্রথম সকালের সেই দুর্লভ মুহূর্তগুলো

ক্ষিতিমোহন সেন ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান নানা সাধকের জীবন ও বাণী নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৯২৬-এ রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে শাস্ত্রের একমাত্রিক কাঠামো বহির্ভূত এই ধর্মের কথা প্রচারের জন্য ইউরোপে পাঠাতে চেয়েছিলেন। ১৯২৯-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু-মুসলমান সেই সাধকদের জীবন ও বাণী নিয়ে ক্ষিতিমোহন সেন অধর মুখার্জি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ক্ষিতিমোহনের বক্তৃতা যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হল তখন সে বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন, ‘রাষ্ট্রিক সাধনা ভারতের সাধনা নয়।’ তা হলে ভারত কী করেছে? রবীন্দ্রনাথ মনে করেন ভারতের সমাজ প্রাণবান সমাজ। সেখানে নানা সময়ে নানা মানুষের ও ধর্মের আসা ও মিশে যাওয়া। রবীন্দ্রনাথের যুক্তি মানলে ‘কমন ফাদারল্যান্ড’ ‘কমন ব্লাড’ ‘কমন রিলিজিয়ন’ ইত্যাদির ধুয়ো তুলে ‘নেশন’ তৈরি করার খোয়াব ভারতীয় সমাজের পরিপন্থী।

সেই যান্ত্রিক ‘নেশন’ তৈরির উনিশ-বিশ শতকীয় খোয়াবনামায় এখন এ দেশের এক দল রাজনীতিবিদ মজে আছেন। তাঁদের অনুগামীরা তো রবীন্দ্রনাথের লেখাকে ভয় পাবেনই। রবীন্দ্রনাথ এ কথাগুলো তো কেবল বাংলায় লেখেননি, নিজের হাতে ইংরেজিতে লিখে সকলের কানে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

কানঢাকা টুপি পরেন যাঁরা, তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তো সমস্যায় পড়বেনই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE