মোবাইলে আটকে চোখ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে স্ক্রল করা চলছে। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে হোক, খেতে বসে বা সফরের সময়ে, ‘রিল’ বা ভিডিয়ো দেখার অভ্যাস আজকাল অধিকাংশেরই। শিশুরাও তার বাইরে নয়। সারা ক্ষণ ডুবে ভিডিয়ো গেমে অথবা ইউটিউব ভিডিয়োতে। ছোটরা ওই নিয়ে মজে আছে দেখে বড়রাও নিশ্চিন্তে নিজেদের কাজ করছেন। আর এতেই ঘনাচ্ছে বিপদ। অত্যধিক ‘স্ক্রিন টাইম’ যে কেবল স্থূলত্বের সমস্যা বৃদ্ধি করছে তা নয়, শিশু ও কমবয়সিদের হার্টের রোগের কারণও হয়ে উঠছে, এমনই দাবি গবেষণায়।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক গবেষণা রীতিমতো উদ্বেগ বাড়িয়েছে। একই রকম গবেষণা করেছে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলও। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ২০২৩ সাল থেকে করা কিছু সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, ২ বছর থেকে ১৯ বছর বয়স অবধি শিশু ও কমবয়সিরা এত বেশি মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে সময় কাটাচ্ছে যে, তাদের বিপাকক্রিয়ার হারে বদল আসছে, শরীরে মেদ জমার প্রবণতা বাড়ছে। আর এর হাত ধরেই ‘কার্ডিয়োমেটাবলিক’ বদল আসছে শরীরে। অর্থাৎ, সারা ক্ষণ বসে বা শুয়ে মোবাইল অথবা ট্যাব দেখার কারণে শারীরিক কসরত প্রায় হচ্ছেই না। এতে খিদে কমছে, কোলেস্টেরল বাড়ছে, সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালনের হারও বিগড়ে যাচ্ছে। ফলে এক দিকে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ দেখা দিচ্ছে ছোট থেকেই, অন্য দিকে সমস্যা দেখা দিচ্ছে হার্টেও।
‘আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিয়োলজি’ এবং ‘সেন্টার ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেশন’-এর তথ্য বলছে, রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে যদি শিশু বা কমবয়সিরা বেশি মোবাইল দেখে বা একটানা স্ক্রল করতে থাকে, তা হলে মেলাটোনিন নামক হরমোনের তারতম্য দেখা দেয়। এই হরমোনই ‘স্লিপ সাইক্ল’ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ঘুমের সমস্যা দেখা দেয় এবং একযোগে চাপ পড়ে শরীরে আর মনে। এই অভ্যাসের প্রভাব পড়তে পারে স্মৃতিশক্তির উপরেও। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, টানা ৩-৪ ঘণ্টা মোবাইলে ভিডিয়ো দেখে কাটালে হৃদ্রোগ ও হাইপারটেনশনের ঝুঁকি বাড়বে। যারা ৪ ঘণ্টারও বেশি মোবাইল একটানা দেখে, তাদের ভবিষ্যতে হার্টের রোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই বেশি।
আরও পড়ুন:
ভারতে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ’-এর জার্নালে এই নিয়ে একটি গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, ৮৭২ জন শিশুকে নিয়ে একটি সমীক্ষা করে দেখা হয়, ৬ মাস, ১ বছর ও ২ বছর বয়সি শিশুরা যদি দিনে ৩ ঘণ্টারও বেশি টিভি দেখে, তা হলে তাদের মধ্যে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। যেমন, তারা খেলাধুলা ছেড়ে ঘুরকুনো হয়ে পড়ে, অন্যের সঙ্গে কথোপকথনে তাদের সমস্যা হয়, এমন কিছু ভাষা শেখে যা তাদের বয়সোচিত নয় এবং তাদের বুদ্ধি, ভাবনাচিন্তা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে।
তা হলে উপায়?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছোটরা মোবাইল, ট্যাবে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শেখার চেয়ে লঘু জিনিসপত্র দেখতেই ভালবাসে। জানার জন্য ইন্টারনেটের প্রয়োজন অবশ্যই, কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাতে বুঁদ হয়ে থাকলে ক্ষতি। তাই পড়াশোনা এবং বিনোদনের সময়কে ভাগ করতে হবে। দরকারে মা-বাবাকেও সেই ভাগ মেনে চলতে হবে, অন্তত ওদের সামনে।
সারা ক্ষণ বসে বা শুয়ে মোবাইল না দেখে, শরীরচর্চার অভ্যাস তৈরি করতে পারলে ভাল হয়।
বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হবে। এমনটাই মত গবেষকদের। ফোনমুখী মনকে বশে রাখতে হলে, নানা ধরনের বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে। ছোটদের গল্প পড়ে শোনান, পারলে অভিনয় করে দেখান। এতে তারা আনন্দ পাবে।
শিশুর স্মার্টফোনের আসক্তি কাটাতে আপনাকে ওর জন্য সময় বার করে নিতে হবে। ওর জন্য দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখুন। তখন শিশুর মনের কথা শুনুন, শিশুর সঙ্গে খেলুন, ওর সঙ্গে গল্প করুন।
সামাজিক মেলামেশা ছোটদের মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে। তাই মোবাইল ছেড়ে তারা যদি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলাধুলো বেশি করে, বা আঁকা, লেখা বা অন্যান্য শখ তৈরি করতে পারে, তা হলে বুদ্ধির বিকাশ ঘটে।