E-Paper

ছোটদের মধ্যেও মধুমেহ

ভারতে মধুমেহ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শুধু বয়স্করা নন, এই রোগ থেকে নিস্তার নেই শিশুদেরও।

ঊর্মি নাথ 

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৫ ০৭:২৫

বয়স্কদের যে ধরনের ডায়াবিটিস হয় তা টাইপ-টু। শিশুদের হয় টাইপ-ওয়ান। টাইপ-ওয়ান ও টাইপ-টু-র মধ্যে পার্থক্য আছে। আমাদের শরীরে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইনসুলিন হরমোন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ইনসুলিনের ঘাটতি হয়। তাদের অগ্ন্যাশয়ে যে বিটা সেলগুলো ইনসুলিন তৈরি করে তা নষ্ট হয়ে যায়। ইনসুলিন ক্ষরণ না হওয়ায় রক্তে শকর্রার মাত্রা বেড়ে যায়। এর জন্য টাইপ-ওয়ানে বাইরে থেকে ইনসুলিন ইনজেক্ট করতে হয়। বড়দের ক্ষেত্রে বা টাইপ টু-তে শরীরে ইনসুলিন রেজ়িস্ট্যান্স তৈরি হয়। ফলে ইনসুলিন স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়ে রেজ়িস্ট্যান্স কমানো হয়, প্রয়োজনে ইনসুলিন ইনজেক্ট করা হয়।

অনেকের ধারণা, বাবা-মা ডায়াবেটিক হলে তাঁদের সন্তানও ডায়াবেটিক হবে। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবিটিস হলে সন্তান জন্মানোর পরে তারও হবে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অপূর্ব ঘোষ বললেন, ‘‘টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিসের জন্য বাবা-মা দায়ী থাকেন না। এটা জেনেটিক সমস্যা নয়। প্যানক্রিয়াসে কেন ইনসুলিন তৈরি হয় না, তার কারণ এখনও পরিষ্কার নয়। জিনঘটিত কারণ বলা যায় টাইপ টু-র ক্ষেত্রে।’’

কত ছোট শিশু ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হতে পারে? উত্তরে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রভাসপ্রসূন গিরি বললেন, ‘‘জন্মের পরের দিন থেকেই হতে পারে। মুশকিল হল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে ধরা পড়ে না। যখন ধরা পড়ে, তখন অবস্থা মারাত্মক হয়, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে ডায়াবেটিক কেটোঅ্যাসিডোসিস। এর ফলে, বাচ্চাটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়। প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা থাকে। আইসিউ-তে রেখে চিকিৎসা করতে হয়।’’

উপসর্গ

টাইপ-ওয়ানের প্রধান উপসর্গগুলো হল, প্রবল জল তেষ্টা, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ, খিদে বেড়ে যাওয়া, ওজন হ্রাস, ক্লান্তিবোধ। এই ধরনের উপসর্গ দেখে অধিকাংশ অভিভাবকই বুঝতে পারেন না। ফলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে দেরি হয়ে যায়।

চিকিৎসা ও দায়িত্ব

ছোটদের টাইপ-ওয়ান ডায়াবিটিস সামাল দেওয়ার একটাই সমাধান ইনসুলিন ইনজেক্ট করা। ‘‘আজীবন ইনসুলিন নিতে হবে। তার সঙ্গে খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি। ডায়াবেটিক বাচ্চাদের দেখাশোনা করা অভিভাবকদের কাছে বেশ চ্যালেঞ্জের। শিশুর এক বছরের কম বয়স হলে তাদের সামলানো আরও কঠিন, কারণ তারা সব সময়ে দুধ খায়,’’ বললেন ডা. গিরি।

টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিসে শিশুদের দিনে-রাতে একাধিক বার ইনসুলিন ইনজেক্ট করতে হয়। নিয়মিত গ্লুকোমিটারে দেখে নিতে হয় রক্তে শর্করার মাত্রা। তাদের সময়মতো খাবার খাওয়াতে হয়। পাশাপাশি ডায়াবিটিক শিশুর জ্বর, সর্দি-কাশি হলে কী ধরনের ওষুধ দেবেন, তখন কী খাওয়াবেন, তা-ও ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হয়। নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা করাতে হবে।

সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও মা-বাবার মনে ভয় তৈরি হয়, বাচ্চাটি কি আর খেলাধুলো, পরিশ্রমের কাজ করতে পারবে? আগামী দিনে কতটা সুস্থ থাকবে? এই বিষয়ে ডা. গিরি বললেন, ‘‘পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার ওয়াসিম আক্রমের টাইপ-ওয়ান ডায়াবিটিস। ইনসুলিন নিয়ে খেলতেন। এমন অনেকেই আছেন। এঁরা স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনযাপন করতে পারবেন। সন্তানের পিতা-মাতাও হতে পারবেন। আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইনসুলিনের মাত্রা ও ডায়েট বদলাতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। এখানে গাফিলতি চলবে না। যার টাইপ-ওয়ান ডায়াবিটিস, তাদের সারাজীবন সেটা থাকে। পরবর্তীকালে কিছু ক্ষেত্রে টাইপ-ওয়ান ও টাইপ-টু দুটোই দেখা যেতে পারে, কিন্তু সাধারণত টাইপ-ওয়ানই থাকে।’’

ডায়েট

বড়দের ক্ষেত্রে ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণ যতটা সহজ, বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ততটাই কঠিন। এই রোগে ডায়েট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপারে পুষ্টিবিদ কোয়েল পালচৌধুরী বললেন, ‘‘টাইপ-ওয়ানে কার্বোহাইড্রেট কাউন্টিং খুব জরুরি। যতটা পরিমাণ ইনসুলিন দেওয়া হয়, সেই অনুযায়ী একজন পুষ্টিবিদ কার্ব কাউন্ট করে খাবারের পরিমাণ ঠিক করেন। এখন এমন মেশিন পাওয়া যায় যা দিয়ে ২৪ ঘণ্টা রক্তে শর্করার মাত্রা মনিটর করা যায়। এতে দেখা যায় কখন গ্লুকোজ় বাড়ছে, কখন কমছে। সেই হিসেবে ডায়েট ঠিক করা যায়। ইনসুলিন যেহেতু দেওয়া হচ্ছে, সেই জন্য ভাত-রুটির পরিমাণ মডারেট করে, প্রোটিন, ফাইবার জাতীয় খাবার দিতে হবে। যেমন ডাল, সবজির সুপ, লো-ফ্যাট দুধ, পনির, টক দই, মুরগি, মাছ, ডিম, ফল বাড়াতে হবে। কার্বোহাইড্রেট বন্ধ করা যাবে না, এতে সুগার ফল করতে পারে। ড্রাই ফ্রুটস দেওয়া যেতে পারে, তবে পরিমাণ মেপে। প্রচুর জল খেতে বলা হয়, শরীর যাতে সব সময়ে হাইড্রেটেড থাকে। চিনির বদলে অল্প গুড় দেওয়া যেতে পারে। প্যাকেটজাত খাবারের পরিবর্তে বাড়িতে মুখরোচক খাবার বানিয়ে দিন। একবারে নয়, দু’-তিন ঘণ্টা অন্তর অল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, বাচ্চাটি যেন রোজ শারীরচর্চা করে।’’ ডায়াবেটিক বলে শিশুটিকে কখনওই খাবার কম দেওয়া যাবে না। এই সময় তাদের বৃদ্ধির সময়। কম খেলে অপুষ্টির কারণে পেশি ঠিক মতো তৈরি হবে না, বাচ্চাটি দুর্বল হয়ে পড়বে।

ছোটদের টাইপ টু ডায়াবিটিস

শুধু বয়স্কদের নয়, এখন ১৩-১৪ বছর বয়সে অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালেও টাইপ-টু ডায়াবিটিস ধরা পড়ছে। এর কারণ অতিরিক্ত চিনি জাতীয়, ময়দা, প্যাকেটবন্দি পানীয়, জাঙ্ক ফুড খাওয়া ও খেলাধুলো না করা। তা ছাড়া পরিবারে ডায়াবেটিক রোগী থাকলে অল্প বয়সেই ডায়াবিটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ‘‘ডায়েটের ক্ষেত্রে টাইপ-ওয়ান ও টাইপ-টুর মধ্যে খুব ফারাক নেই। অভিভাবকরা খেয়াল রাখবেন, বাচ্চা যাতে টিভি বা ফোন দেখে না খায়। এতে হজমের সমস্যা হয়। এ ছাড়া মাঠে গিয়ে খেলা, সাঁতার, যোগাসন বা নাচ নিয়মিত করানো জরুরি। শারীরচর্চা করলে ইনসুলিন হরমোন ঠিক মতো নিঃসৃত হয়। অনেক ডায়াবেটিক বাচ্চার অভিভাবক তাদের সাপ্লিমেন্ট খাওয়াতে চান। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সাপ্লিমেন্ট খাওয়ানো উচিত নয়,’’ বললেন কোয়েল।

শুধু শরীরে নয়, একজন ডায়াবিটিক শিশুর মানসিক সমস্যা হতে পারে। খাদ্যতালিকা থেকে তাদের পছন্দের চকলেট, আইসক্রিম, কেক ইত্যাদি বাদ দিতে হয়। ফলে তাদের মনের উপরে চাপ পড়ে, যখন দেখে অন্য বাচ্চারা এ সবে বঞ্চিত নয়। তাই মনের দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে।


(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Diabetes

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy