দিনে দিনে কত কিছুই যে ঝরে পড়ল বাঙালির জীবন থেকে! দুরু দুরু বুকে খাম খুলে চিঠি পড়ার দিন গত। প্রেমের কথাকে হাইজ্যাক করেছে মোবাইল ফোন। সেই ছাদ, চিলেকোঠার ঘর, পাড়ার রকের আড্ডা আর কোথায়? টেবিলে একসঙ্গে বসে নৈশভোজ সারতে সারতে নির্ভেজাল গল্পের দিনও গত হতে চলেছে। এখন খাওয়ার টেবিলেও মোবাইল নিয়ে যে যার মতো আলাদা। মনখারাপ ভাগ করে নেওয়ার সময়টুকুও নেই। আর তাতেই যত মনের রোগের আনাগোনা। অবসাদ বা উদ্বেগ কমাতে নানা রকম থেরাপির নিদান দেওয়া হচ্ছে এখন। তবে গবেষকেরা অনেক ভেবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছেন, রুটিন কাউন্সেলিং বা জটিল থেরাপি নয়, অবসাদের মেঘ কাটাতে পারে মনখোলা আড্ডাই।
ডিনার টেবিলের বিলাস যখন ছিল না, মাটিতে আসন পেতে সকলে গোল বসে বসে রাতের খাওয়া সারতে সারতে আলোচনা, তর্কের ঝড় উঠত। কখনও সখনও সে তর্ক ঝগড়া অবধি গড়াত না, তা নয়। তবে তাতেও ছিল ভালবাসার ছোঁয়া। একসঙ্গে বসে সকলের মতামত শোনার অভ্যাসে আখেরে লাভই হত। সেই সময়টুকুর জন্য সারা দিনের কত মনখারাপ, ভাল না লাগা হারিয়ে যেত। বাঙালি বাড়িতে, বিশেষ করে যৌথ পরিবারগুলিতে একসঙ্গে বসে রাতের খাওয়া সারার রেওয়াজ বহু দিনের। এখনকার ছোট পরিবারগুলিতেও তেমনই আছে। তবে দিন যত এগোচ্ছে, ততই নিঃসঙ্গতা বা সকলের মাঝেও একলা হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। হাতের বৈদ্যুতিন যন্ত্র নির্ভেজাল আড্ডায় বাধ সেধেছে। একে অপরের সঙ্গে কথোপকথন যত ফুরোচ্ছে, ততই উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে। একাকিত্ব, অবসাদে ভুগে শেষমেশ মনোবিদের কাছে দৌড়তে হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
২০২৪-এ ‘ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি‘ এবং বস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের তরফে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে গবেষকেরা জানিয়েছিলেন, ৫৮ শতাংশ ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে প্রচণ্ড মানসিক চাপে ভোগেন। এর কারণই হল কাজের জায়গায় নিজের অসুবিধাগুলো ভাগ করে নেওয়ার মানুষ নেই। সকলেই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে চান। বাড়ি ফিরেও সকলে যে যার মতো আলাদা। ওয়েব সিরিজের এপিসোডে চোখ রেখেই কেটে যাচ্ছে অর্ধেক রাত। পরদিন আবার সেই উদ্বেগ। ফলে দুশ্চিন্তার মেঘ কাটার বদলে তা দিনে দিনে আরও ঘনীভূত হচ্ছে এবং একটা সময়ে গিয়ে অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডারের কারণ হয়ে উঠছে।
মন ভাল রাখতে সেই নিখাদ, নির্ভেজাল আড্ডাকেই ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিচ্ছেন গবেষকেরা। সে খাওয়ার টেবিলে একসঙ্গে বসে হোক বা অবসর সময়ে, একে অপরের সঙ্গে কথা বলাই মনখারাপের আসল দাওয়াই। এতে অক্সিটোসিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে। এই হরমোনকে বলে ‘বন্ডিং হরমোন’ বা বন্ধলের হরমোন, যা মনকে সতেজ করে তুলতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। আড্ডার আলোচ্য বিষয় যেমনই হোক না কেন, তাতে যতই তর্ক-বিতর্কের ঝড়ও উঠুক না কেন, তবুও তা মনের জন্য ভাল। হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজবই আসল কাউন্সেলিং যা অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডার, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজ়অর্ডার, সোশ্যাল ফোবিয়া বা যে কোনও মেন্টাল ডিজ়অর্ডারও নিরাময় করতে পারে বলেই দাবি গবেষকদের।