E-Paper

প্রবীণরা পড়ে গেলে বিপদ কতটা?

পরিবারে প্রবীণদের পড়ে যাওয়া নিয়ে আতঙ্কে থাকেন? প্রতিরোধের ব্যবস্থা নাগালে রাখুন

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০২৫ ০৭:১৯

বয়সকালে যে সব স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা তৈরি হয়, তার মধ্যে অন্যতম হল পড়ে যাওয়া। সেই পরিস্থিতি তৈরি হলেও কমবয়সিরা নিজেকে সামলে নিতে পারেন। বয়স্কদের ক্ষেত্রে সে সুযোগ কম। কারণ, মস্তিষ্কের ক্ষয় হতে থাকে, এ ধরনের ‘কমপেনসেটরি মেকানিজ়ম’ কমে যায়। এ বিষয়টি নিয়ে পরিজনরা একটু চিন্তাতেই থাকেন। দেখা গিয়েছে, পড়ে যাওয়ার পরে বয়স্ক মানুষের নানা রোগ প্রকাশ্যে আসে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ারও দরকার হতে পারে। আর আহত না হলেও, পড়ে গেলে বৃদ্ধ মানুষটির আত্মবিশ্বাসের অভাব হতে পারে। ইচ্ছেমতো হেঁটেচলে বেড়ানোয় শঙ্কিত হয়ে যেতে পারেন। এতে তাঁর সক্রিয়তায় প্রভাব পড়ে। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে এই পড়ে যাওয়ার বিপদ থেকে বাঁচাতে একটু সচেতনতা, সতর্কতা প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে জরুরি পরামর্শ দিলেন জেনারেল ফিজ়িশিয়ান সুবীর কুমার মণ্ডল।

সমস্যার মূল সন্ধানে

অস্টিয়োপোরেসিসের ফলে পঞ্চাশের পরেই সারভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিসের কারণে মাথা ঘোরার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর থেকেই ষাটের কোঠায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ে যাওয়াকে ‘সিঙ্কোপ’ বলা হয়, কথ্য ভাষায় ব্ল্যাক আউট। তাড়াহুড়োয় জলবিয়োগের সময় যে সঙ্কোচন প্রসারণ হয়, ব্লাডারের উপরে জোর দেওয়ার জন্য মস্তিষ্কে যে চাপ বাড়ে, তার জন্য শৌচাগারে এই ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। ডা. মণ্ডল বললেন, “সমস্যার মূলে কিন্তু হার্ট। আমরা যখন শুয়ে থাকি, তার পর যখন বসি আর উঠে দাঁড়াই— তিন ভঙ্গিমায় তৎক্ষণাৎ গড়ে পাঁচ-সাত ক্রমাঙ্ক করে রক্তচাপ বাড়ে। ফলে রক্তচলাচল ঠিক রাখতে হার্টের পাম্পিং বেশি প্রয়োজন হয়। এ অবস্থা একটু পরেই ঠিক হয়ে যায়। তবে বয়সকালে হৃদয় কমজোরি হয়ে থাকলে এ সময়ে মস্তিষ্কে রক্তের জোগান ব্যাহত হয় এবং মানুষ পড়ে যান। এ-ও শরীরের ‘কমপেনসেটরি মেকানিজ়ম’। কারণ পড়ে গিয়েই শরীর আবার আনুভূমিক অবস্থানে আসে ও মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন ঠিক হয়ে যায়। ফলে তখন পড়ে গিয়ে মাথা ফাটলেও ‘পার্মানেন্ট ব্রেন ড্যামেজ’-এর সম্ভাবনা কমে। আবার অনেক সময় দাঁড়াতে গেলে রক্তচাপ কমে যায়। তাকে বলে ‘পশ্চুরাল হাইপোটেনশন’। তার ফলেও পতন হয়।” কিছু কার্যকর ওষুধের (বিশেষত প্রেশারের) কারণে এমনটা ঘটে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রেসক্রিপশনেই লিখে রাখার কথা। এমন প্রেশারের ওষুধ সাধারণত রাতে খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।

হৃদ্স্পন্দন ৪০-এর নীচে নেমে গেলেও হার্টের পাম্পিং ঢিমে হয়ে যায়, ব্রেনে আবার রক্ত জোগানের সমস্যা হয়ে পড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ডায়রিয়া, জলশূন্যতা, অনেকক্ষণ না খাওয়ার ফলেও রক্তচাপ কমে এমন হয়। যে ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়, নানা কারণে বয়স্কদের সেই নালি সরু হয়ে যায়। রক্ত তখনও মস্তিষ্কে যাওয়ার পথ পায় না, ফল আকস্মিক পতন। ডা. মণ্ডল বললেন, “একটা বয়সের পর সোডিয়াম আত্তীকরণও কমে যায়। তাই ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশনে (তিনটে ওষুধ ফুল ডোজ়ে দিয়েও প্রেশার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে) চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নুন ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। লিভার, কিডনির সমস্যা থাকলে নিয়মিত সোডিয়াম-পটাশিয়াম লেভেল পরীক্ষা করান। সোডিয়াম কমলে মানুষ শয্যাশায়ী হয়ে যান। পটাশিয়াম নিয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। এর মাত্রা বাড়লে বা কমলে কিন্তু হার্টের ক্ষতি ও নানা সমস্যা হয়। এ ছাড়া অন্তর্কণের্র সমস্যা, চোখে কম দেখাও পড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।” মেনোপজ়ের পর বয়স্ক মহিলাদের অস্টিয়োপোরেসিস শুরু হলে হাড় নরম হয়। তখন হঠাৎ ‘পড়ে গিয়ে হাড় ভাঙা’র কথা প্রায়ই শোনা যায়।

পড়ে গেলে স্ট্রোক হয়, এ ধারণাও ভুল। চিকিৎসকদের মতে, স্ট্রোক হওয়ার কারণেই মানুষ পড়ে যান। কোনও কারণে মাথার ভিতর রক্তক্ষরণ হলে ওই অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে কিংবা রক্তচাপ, শর্করার মাত্রা কমে গেলে, সেই অবস্থায় হাঁটলে প্রবীণরা পড়ে যেতে পারেন। পড়ে যাওয়া টিউমারেরও লক্ষণ।

প্রতিরোধের সুব্যবস্থা

কলার পরে থাকলে সারভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিসকে ছ’মাসে হারিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যায়। তাই সমস্যা থাকলে গলায় কলার পরতে অনীহা দেখাবেন না। তেমনই, মহিলারা একটা বয়সের পর ‘বোন মিনারেল ডেনসিটি’-র পরীক্ষা করিয়ে কত শতাংশ হাড় নরম হয়েছে জেনে রাখুন। সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করলে হাড় ভাঙার সম্ভাবনা কমবে।

বয়স্কদের নিয়মিত চেকআপে নিয়ে যান, প্রেশার-সুগার নিয়ন্ত্রণে আছে কি না লক্ষ রাখুন। ওঁরা ভুলে ওষুধ দু’বার খেয়ে নিতে পারেন। এতে ওভারডোজ় হয়ে নানা বিপত্তি ঘটে। বিদেশি ঢঙের শৌচাগার নিরাপদ। শৌচালয়ের দেওয়ালে হ্যান্ডেলের ব্যবস্থা, ঘরে অ্যান্টি স্কিড (পা পিছলে যায় না) পাপোশ, ম্যাট্রেস রাখলে সুরক্ষা পাবেন।

বেড সুইচের ব্যবস্থা করতে পারলে ভাল। তবে সম্ভব হলে প্রবীণদের শোয়ার ঘরে, স্নানাগারে নাইটল্যাম্পের বদলে সেন্সরি লাইটিং সিস্টেমের ব্যবহার করতে পারেন। এতে হাত-পা নাড়ানো, চলাচল শুরু করলে বা দরজা খুললে আপনা হতে আলো জ্বলে উঠবে। অন্ধকারে ঠোক্কর খাওয়া ও পড়ে যাওয়ার দুর্ঘটনা থেকে রেহাই মিলবে।

বিপদ এলে

  • জ্ঞান থাকলে, মাথা ঘুরছে মনে হলে বসে পড়া উচিত।
  • পড়ে গেলে প্রথমেই আতঙ্কিত হবেন না। প্রাথমিক শুশ্রূষার ব্যবস্থা করুন। আহত অংশ ফুলে উঠলে বরফ দিন। তবে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে কোনও আঘাত লাগলে মুশকিল হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ, নিশ্চিন্ত হতে এমআরআই করিয়ে নেওয়া উচিত। রোগীর শরীরে পেসমেকার থাকলে সিটি স্ক্যান-ও করিয়ে নিন।

বয়স বাড়লেই যে এই ধরনের সমস্যা শুরু হবে, তা নয়। নিয়মমাফিক, সুস্থ জীবনযাপনের মাধ্যমে শরীরের জীর্ণতার অনেকটা মোকাবিলা করা যায়। দেখা গিয়েছে স্বাস্থ্যকর খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম, শারীরচর্চার অভ্যাস ও মস্তিষ্কের ব্যায়াম বয়সজনিত সমস্যা দূরে সরিয়ে মানুষকে সচল রাখে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Senior citizen

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy