Advertisement
E-Paper

১০ মাসে ২০ কেজি ঝরিয়েছি! জিমে যাইনি, যাইনি কোনও পুষ্টিবিদের কাছেও

হঠাৎ যদি দেখেন ওজনের কাঁটা ১০০ ছুঁইছুঁই, কী করবেন তখন? এমন হয় আশপাশে অনেকের জীবনেই। সময় থাকতে থাকতে সামলে নেওয়া যায়।

শৌভিক দেবনাথ

শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৯
How I lost 20 kilograms in 10 months, weight loss journey of a professional

জিমে না গিয়েই ঝরল ২০ কেজি। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

আমি কখনও জিমে যাইনি। জিমে যাওয়ার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজন, তা আমার নেই। বয়স ৩৯, সংবাদমাধ্যমে কাজ করি। অফিস পৌঁছনোর সময়ের ঠিক থাকলেও, বেরোব কখন, তার কোনও ঠিক নেই আমার পেশাগত কারণে। ফলে চেষ্টা করলেও যে নিয়ম মেনে জিমে যেতে পারতাম, এমন নয়।

গত জানুয়ারি মাসে এক দিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময়ে মেট্রো স্টেশন দাঁড়িয়ে মনে হল, ঠিক করে শ্বাস নিতে পারছি না। কষ্ট হচ্ছে। তার ঠিক আগেই বোল্ট-গতিতে (দ্রুততম ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত উসেন বোল্টের মতো গতি বলতে চেয়েছি) দৌড়ে ট্রেন ধরতে গিয়েছিলাম। তবু ধরতে পারিনি। আবার ১০ মিনিটের অপেক্ষা। তখনই হঠাৎ চোখ গেল ওজন মাপার যন্ত্রটির দিকে। পকেট থেকে পাঁচ টাকার কয়েন বার করে উঠে পড়লাম। তার পর ফলাফল যা হাতে‌ এল, তা দেখে চক্ষু ছানাবড়া। আমার ওজন নাকি ৯৬ কেজি।

আমার যেমন কাজ, তার জন্য টানা অনেক ক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে হয়। বয়সের সঙ্গে এই অভ্যাস জটিলতা বাড়ায়। মেদ বৃদ্ধি তো হয় বটেই। আর তার সঙ্গে থাকে আরও নানা রোগ হওয়ার ঝুঁকি। যেমন অনেকের কম বয়সেই ডায়াবিটিস হয়ে যায়। ভয় তো থাকেই। সুগার হতে আর কত দিন? হঠাৎ হয়তো দেখব, তা-ও হয়ে গিয়েছে!

সমাধান কী? আসলে কিন্তু কেউ জানে না। এক এক জন এক এক রকম বলে। তবে অধিকাংশেই বলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা। সেটাতেই গুরুত্ব দিলাম।

How I lost 20 kilograms in 10 months, weight loss journey of a professional

মিষ্টির দিকে আর তাকাই না। ছবি: সংগৃহীত।

জিম যাওয়ার সময় নই। গুগ্‌লে পাওয়া ডায়েট চার্টেও ঠিক ভরসা করার কারণ নেই। কতটা বিজ্ঞানসম্মত তো জানি না। পুষ্টিবিদের কাছে যেতে পারি, কিন্তু সে সব খুব কঠিন ডায়েট হয়। আমাকে দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। অতশত সম্ভব নয়। ভাবলাম ঘরোয়া পদ্ধতি মেনে চলি আগে। যেমন, প্রথমেই বাইরের খাবার আর মিষ্টি খাওয়া ছাড়লাম।

জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে অনেকটা বদল এসেছে চেহারায়। কমেছে ওজন। সঙ্গে চিন্তার ভারও। ধীরে ধীরে আরও বদলে ফেলেছি জীবনধারা। ফিরে যাই দশ মাস আগের সময়টায়। মাসে মাসে একটু করে কিন্তু বদলে গেল জীবন।

জানুয়ারি

অফিস থেকে বেরিয়ে প্রায় উসেন বোল্টের মতো দৌড়েও যে দিন ট্রেন ধরতে পারিনি, সে দিন থেকেই ভাবনার শুরু। আসলে তো আর বোল্টের ধারকাছের গতিতেও দৌড়ের ক্ষমতা আমার ছিল না। এখনও নেই। শুধু শরীর যে কষ্ট অনুভব করেছিল, তাতে মনে হয়েছিল যেন বোল্টের মতো দৌড়েছি। তার পরই জানতে পারলাম আসল কারণটা। কারও ৯৬ কেজি ওজন থাকলে সামান্য গতিতে দৌড়োলেও কষ্ট হবেই। সে দিন শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া পর থেকে চিন্তা হয়। তবে এর পর করণীয় কী, তা ভাবতে ভাবতেই মাস কাবার করে দিয়েছিলাম। কখনও ভাবলাম জিমে যাই, কখনও মনে হল সকালে উঠে খানিকটা দৌড়োই। কোনওটাই আসলে করা হল না।

ফেব্রুয়ারি

আগেই বলেছি, জিমে যাওয়ার জন্য যে মানসিক দৃঢ়তার প্রয়োজন, তা আমার নেই। তাই ঠিক করলাম খাবারে বদল আনব। প্রথম ছাড়লাম দুধ-চা এবং অবশ্যই চিনি। শুরু হল চা নিয়ে কড়াক়ড়ি। সারাদিনে ঠিক দু’কাপ চা। দুধ-চিনি ছাড়া। অভ্যাস করে ফেললাম কম সময়েই। তার পর মনে হল, আরও কিছু বদল আনা দরকার। কিছু দিন পর ঠিক করলাম প্রিয় বিরিয়ানি এবং খাসির মাংস খাওয়া বন্ধ করে দেখি। তাতেই শরীরে অপ্রয়োজনীয় তেল-চর্বি যাওয়া অনেকটা কমবে। অফিসে কোনও বিশেষ দিনে সকলে মিলে এ সব খাওয়া লেগেই থাকত। তা ছাড়া নেমন্তন্নবাড়ি তো আছেই। নিজের বাড়িতেও কখনও কখনও খাওয়া হয় সকলে মিলে বিরিয়ানি। সব বন্ধ করলাম। শুরু হল আমার ‘ফিট’ থাকার যাত্রা।

How I lost 20 kilograms in 10 months, weight loss journey of a professional

প্রথম ছেড়েছি দুধ চা। ছবি: সংগৃহীত।

মার্চ

এক মাস চিনি-বিরিয়ানি আর পাঁঠার মাংস বাদ দিয়ে চলতে পেরে নিজের মনের জোরের উপর ভরসা হল। এ বার ঠিক করলাম, বাইরের সব রকমের খাবার নৈব নৈব চ। প্রথম প্রথম সত্যি খুব অসুবিধা হত। এত দিনের অভ্যাস একবারে কি ছাড়া যায়! কিন্তু তখন মনে পড়ে গেল চাঁদনি চক স্টেশনের সেই ওজন মাপার যন্ত্রের কথা। ফলে কষ্ট করেই নিজের খাওয়াদাওয়ায় লাগাম টানলাম।

এপ্রিল

মাসের শুরুতেই পাঁচ টাকা দিয়ে আবার উঠে পড়লাম চাঁদনি চক স্টেশনের সেই যন্ত্রে। এ বার ওজন এল ৯০ কেজি। এ তো চমকপ্রদ তথ্য! অনেক দিন পর বেশ একটা ভাল লাগা ভিতরে ভিতরে কাজ করল। কিন্তু, জানতাম আমি আমার লক্ষ্য থেকে এখনও বহু দূরে। তবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ পেলাম। আমার বাবা একটি কথা প্রায়ই বলেন— ‘সকালে খাও রাজার মতো, দুপুরে খাও প্রজার মতো আর রাতে খাও ভিখিরির মতো’। সকালে পেট ভোরে খাওয়া উচিত (নিয়ম করে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে প্রাতরাশ করা উচিত), দুপুরবেলা কম খাওয়া উচিত (সাড়ে ১২টার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজ) আর রাতে একদম কম। খুব বেশি হলে রাত ৯টার মধ্যে খেয়ে নেওয়া উচিত। তা হলে খাবার হজম হওয়ার জন্য সময় পাওয়া যা। তবে আমি খাই রাত ১০টার পরে। অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয় তো! গত দু’মাস ধরেই সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এক গ্লাস গরম জল খাই। প্রাতরাশে ওট্‌স খাই। এগোরাটা নাগাদ ফল। যে কোনও ফল হলেই হল। কিন্তু একটির বেশি খাই না। শুধু আঙুর হলে ছোট বাটির এক বাটি মতো খাই। দুপুরবেলা ভাত, ডাল, মাছ অথবা ডিম, অনেকটা সব্জি আর টক দই। বিকেলে ৪টে নাগাদ গ্রিন টি। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ মুড়ি অথবা সেদ্ধ ছোলা। রাতে দু’টি রুটির সঙ্গে সব্জি।

How I lost 20 kilograms in 10 months, weight loss journey of a professional

বিরিয়ানি খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ। ছবি: সংগৃহীত।

মে থেকে অগস্ট

এই চার মাস আমি রোজ একই রুটিন মেনে চললাম। দেখলাম, কিছুতেই বাইরের কোনও খাবার খেতে আমার আর ইচ্ছা হয় না। বুঝলাম, মানুষ অভ্যাসের দাস। এই চার মাসে আমি এক বারের জন্যও চাঁদনি চকের ওজন মাপার যন্ত্রে উঠিনি। এই চার মাসে বেশি করে হাঁটা (জোরে হাঁটা) অভ্যাস করলাম। বাজার যাওয়া, স্টেশনে ট্রেন ধরা— সব হাঁটা। অগস্ট মাসে আমি লিভার ফাংশন টেস্ট করালাম। সব স্বাভাবিক, তবে এসজিপিটি কমলেও স্বাভাবিক হয়নি। গত বছর ছিল ৯০, এ বার ৬০। ৪৫ হল স্বাভাবিক। এসজিপিটি পরীক্ষা করালে বোঝা যায়, লিভার কতটা সঙ্কটে রয়েছে।

সেপ্টেম্বর

একে পুজোর মাস, তার উপর আমাদের গ্রামের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। অবধারিত ভাবেই খাওয়ার অনিয়ম হবে। কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই চাঁদনি চক স্টেশনে ওজন মাপার যন্ত্রটার ছবি ভেসে ওঠে। সে কারণেই আমি গোটা পুজোয় একটাও মিষ্টি খাইনি। বাড়ির সকলের অনুরোধে অষ্টমীর দিন একটা এগরোল খেয়েছিলাম, তা-ও সস্‌ ছাড়া। বাকি সব ঘরে বানানো খাবার। পুজোর সময়েও আমি নিয়ম করে প্রতিদিন ১৫ মিনিট ব্যায়াম করেছি।

How I lost 20 kilograms in 10 months, weight loss journey of a professional

বাইরের রোল-চাউমিনের লোভে আর পড়ি না। ছবি: সংগৃহীত।

অক্টোবর

গত সপ্তাহে আমি এক দিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওজন মাপলাম। এখন আমার ওজন ৭৬ কেজি। দশ মাসে আমার ২০ কেজি ওজন কমেছে। তা হয়েছে শুধু রোজের খাওয়াদাওয়ায় কিছু বদল এনে এবং তা নিয়ম করে মেনে। এখন মেট্রো ধরার জন্য দৌড়োলে আমার শ্বাসকষ্ট হয় না, বত্রিশ কোমরের জিন্‌স অনায়াসে হয়ে যায়। আগে তা হচ্ছিল না। খানিক কষ্টই হত জিন্‌স পরতে।

আমার কথা শুনে সহকর্মীরা মাঝেমাঝে জানতে চেয়েছেন, কী কী নিয়ম পালন করছি। কেউ বা বলেছেন, নিজের মতো করে এত বদল না আনতে। তবে আমি খাওয়াদাওয়ায় এমন কোনও বদল আনিনি, যার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। আমি শুধু সাধারণ খাবারে নিজেকে আটকে রেখেছি। চায়ে চিনি না খাওয়া বা বাইরের রোল-বিরিয়ানি না খাওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ খুব জরুরি বোধ হয় নয়। কোন চিকিৎসকই বা বলবেন, নিয়মিত বাইরের ভাজাভুজি খেতে। আর সেটুকু নিয়ম মেনে যদি ফল পাওয়া যায়, তা হলে ক্ষতি কী?

Weight Loss Tips weight loss journey
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy