সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর গর্ভাশয়ের যত্ন নেওয়া বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। আলাদা করে গর্ভাশয় বা জরায়ু নয়, সামগ্রিক ভাবেই অ্যাবডমিনাল হেলথ যাতে ভাল থাকে, দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসে, তার জন্য বিশেষ কিছু শারীরচর্চা ও খাওয়াদাওয়ার নিয়ম অনুসরণ করা দরকার। সন্তানের জন্মের পরে তলপেটে ব্যথা, সেই অংশটি ঝুলে যাওয়া, পেটের গড়ন আগের অবস্থায় না ফেরা… ইত্যাদি সমস্যা খুবই পরিচিত। এ ছাড়া জরায়ুর দেওয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া, স্কার টিসু তৈরি হওয়া, রক্তক্ষরণ কিংবা সংক্রমণের মতো সমস্যা দেখা দিলে সতর্ক হওয়া দরকার প্রথম থেকেই।
গর্ভাশয়ের যত্নআত্তি
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানালেন, শরীরের যে অঙ্গটি ন’মাস ধরে আর একটি প্রাণকে লালন করে, জন্ম দেওয়ার পরে সেটির বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। “এটা শুধু রিকভারির প্রশ্ন নয়। যে আধার এত দিন ধরে নতুন একটা প্রাণ সৃষ্টি করল, এটা তার প্রতি যত্নশীল হওয়ার প্রশ্ন। বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া, হাইড্রেশন… বেসিক কিছু নিয়ম মানতেই হবে। সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে, বিশেষ করে সি সেকশনের পরে অ্যাবডমিনাল হেলথ আগের মতো রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করাতে হবে নিয়মিত,” বললেন ডা. চট্টোপাধ্যায়।
তিনি জোর দিলেন শুধুমাত্র ব্রেস্টফিডিংয়ের উপরে। জানালেন, সন্তানকে প্রথম ছ’মাস বুকের দুধ খাওয়ালে তা মায়ের গর্ভাশয়কেও দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
সমস্যা ও তার মোকাবিলা
অনেকের ক্ষেত্রেই সন্তানের জন্ম দেওয়ার ঠিক আগে বা পরে নানা সমস্যা তৈরি হয়, বিশেষ করে সি সেকশন হলে। ইউটেরাসের ইনার লাইনিং পাতলা হয়ে যাওয়া তার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা। গর্ভাশয়ের এই অভ্যন্তরীণ পর্দাটির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানেই গর্ভস্থ সন্তান বেড়ে ওঠে। কোনও কারণে এই পর্দার পুরু ভাব হ্রাস পেলে তা পরবর্তী কালে মা হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ডা. চট্টোপাধ্যায় জানালেন, কিছু ওষুধের সাহায্যে এর চিকিৎসা করা সম্ভব, “ইউটেরাসের ভিতরে রক্ত সঞ্চালন ভাল করার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে। এতে সেই পর্দা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে দ্রুত। এ ছাড়া কোনও স্কার তৈরি হলে তা-ও রিমুভ করা সম্ভব। সমস্যা তৈরি হলে ঠিক সময়ে তার চিকিৎসা করলে দ্বিতীয় প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধে হয় না।”
নির্দিষ্ট বিরতি
দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের আগে ঠিক কতটা সময় বিরতি দেওয়া প্রয়োজন? এ ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো না করাই ভাল। মায়ের শরীরকে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার মতো সময় দিতে হবে। এখন চিকিৎসকেরা বলেন, দ্বিতীয় সন্তান পরিকল্পনা করার আগে অন্তত দু’বছর অপেক্ষা করতে। বিশেষ করে যদি প্রথম সন্তান সি-সেকশনের মাধ্যমে জন্ম নেয়।
ফিজ়িয়োথেরাপির সাহায্য
অ্যাবডমিনাল মাসলের জন্য বিশেষ কিছু ব্যায়াম রয়েছে। পেশাদার ফিজ়িয়োথেরাপিস্টের সাহায্য নিয়ে সেগুলি শুরু করা যেতে পারে সন্তান জন্মের সপ্তাহখানেক পর থেকেই। ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সোনালি সেনগুপ্ত বললেন, “ডেলিভারির পরে নয়, এই যত্ন শুরু করা দরকার সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে থেকেই। এক্সারসাইজ় করলে প্রসব যন্ত্রণা কম হয়, সার্জনের সুবিধেও হয় কারণ পেশিগুলো কমনীয় থাকে। আর সি সেকশনের কয়েক সপ্তাহ পর থেকে চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম শুরু করা দরকার।”
কনট্র্যাকশন থেরাপির মাধ্যমে ঝুলে যাওয়া, লুজ় হয়ে যাওয়া পেশিকে টাইট করাই মুখ্য উদ্দেশ্য এই ধরনের ব্যায়ামের। দু’টি পা বন্ধ করে ব্যায়াম করা, পেটটাকে চেপে শারীরচর্চা করা এ ক্ষেত্রে ফলদায়ী। নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে হাঁটা, ওঠা-বসা, বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর ভঙ্গি— সবই নিয়ম মেনে করলে উপকার পাওয়া যায়। সোনালি বললেন, “ব্যক্তিবিশেষে আমরা আলাদা ব্যায়াম করার পরামর্শ দিই। ডেলিভারির পরে লোয়ার ব্যাক মাসল আর সায়াটিকা নার্ভ খুব বেশি করে প্রভাবিত হয়। সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে শরীর যে অবস্থায় ছিল, তা সেই অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য থাকে। অনেকেরই অ্যানাস্থেশিয়ার ব্যথা বহু দিন পর্যন্ত থাকে। নির্দিষ্ট ব্যায়ামে তা সারিয়ে তোলাও সম্ভব।”
একাধিক পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ় আছে, যেগুলি করলে পেট ও তলপেটের পেশি দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরে আসে। ইউটেরাস, ওভারির স্বাস্থ্য ফেরাতেও কার্যকর এই ব্যায়ামগুলি। তবে এগুলি করার আগে পেশাদার কারও কাছ থেকে জেনে নিয়ে করাই ভাল।
সদ্যোজাতর খেয়াল রাখতে গিয়ে অনেক সময়েই মায়েরা নিজেদের প্রতি অবহেলা করেন। আপাতদৃষ্টিতে কোনও অসুবিধে না হলেও একজন নতুন মায়ের নির্দিষ্ট সময় অন্তর চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চেকআপ করানো দরকার। জরায়ু, ডিম্বাশয়ের মতো অঙ্গগুলির প্রতি যত্নশীল হতে হবে বিশেষ ভাবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)