‘বিষ’ শব্দটির মধ্যেই যেন এক অদ্ভুত রহস্যের গন্ধ মেলে। দিব্যি সুস্থ-সবল মানুষ, কিছু খাওয়া বা পান করার পরেই আচমকা তাঁর অসুস্থ হয়ে পড়া এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সব শেষ— কিছু ক্ষেত্রে বিষের মতো এমন নির্ভুল প্রাণনাশক আর দ্বিতীয়টি হয় না। মানবশরীরে বিষ ঢুকলে অবিলম্বে কী করা উচিত, কেমন তার চিকিৎসাপদ্ধতি— আলোচনা করলেন চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার।
প্রকারভেদ
সরাসরি খাওয়া বা খুব চেনা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিষ প্রবেশ করতে পারে। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে অনেক সময়ে বোঝা যায় না, মৃত্যু কী ভাবে হল। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধও বিষের মতোই কাজ করে। আবার বোতলে রাখা কেরোসিনকে জল ভেবে খেয়ে নিয়ে মৃত্যু ঘটেছে— এমন ঘটনাও আছে। গ্রামের দিকে সহজলভ্য কীটনাশক। তা খেয়ে বহু মৃত্যুর কথা শোনা যায়। সবচেয়ে মারাত্মক ‘প্যারাকোয়াট পয়জ়নিং’। এই আগাছানাশক শরীরে প্রবেশ করলে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
ঘর পরিষ্কারের ফিনাইল বা বাড়িতে মজুত কার্বলিক অ্যাসিড খেয়ে যখন কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, তখন সেই বিষাক্ত তরল গলা থেকে শুরু করে শরীরের ভিতরের অংশ পুড়িয়ে দেয়। সুতরাং, যিনি খেয়েছেন তিনি কতটা পরিমাণে খেয়েছেন, কত ক্ষণ ধরে খেয়েছেন, তার উপরে নির্ভর করবে তাঁর শরীরের অভ্যন্তরে গলা থেকে শুরু করে স্টমাক পর্যন্ত কতটা জায়গা পুড়েছে, কতটা ক্ষতি হয়েছে। আবার কেউ যদি আগাছানাশক বা কীটনাশক পান করেন, তবে সেটি শরীরের ভিতরের অংশকে পুড়িয়ে দেওয়ার চেয়েও স্নায়ুকে অকেজো করে বেশি। তাই এদের বলা হয় ‘নার্ভ পয়জ়নিং’। ধুতুরা থেকেও এক ধরনের বিষ পাওয়া যায়, যা বেশি পরিমাণে খেলে স্নায়ুর ক্ষতি হয়। বেশি পরিমাণে ঘুমের ওষুধ খেলে আবার মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় খুব বেশি। তাই কী ধরনের বিষ শরীরে ঢুকছে, তার উপরে নির্ভর করবে সেটি স্নায়ুর ক্ষতি করবে, নাকি সরাসরি খাদ্যনালির, না শ্বাসনালির? এর উপরেই চিকিৎসা নির্ভর করে।
বিষক্রিয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রকারভেদ দেখা যায়। তার মধ্যে একটি হল— বিষ শরীরে ঢুকেছে, অনেকটা পরিমাণেই ঢুকেছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু হয়েছে। আবার এমনও হতে পারে, রোজ একটু একটু করে বিষ শরীরে ঢুকছে, অথচ যাঁর শরীরে ঢুকছে, তিনি জানেনই না। হয়তো কোনও বিষাক্ত রাসায়নিক কারখানায় গ্যাস লিক হয়েছে। সেখানে যাঁরা কাজ করেন, শ্বাসের মাধ্যমে সেই বিষাক্ত গ্যাস তাঁদের শরীরে ঢুকতে পারে। ফলে প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাঁদের চোখ, ফুসফুস। শীতের দিনে বদ্ধ জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে ঘুমোতে যান অনেক দরিদ্র পরিবারের মানুষ। ঘুমের মধ্যেই বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসে তাঁদের মৃত্যুর ঘটনা প্রায় প্রতি বছরই সংবাদে উঠে আসে। একেও বিষক্রিয়ার মধ্যেই ফেলা যায়।
উপসর্গ কী
যিনি বিষ খাবেন, তাঁর মুখ দিয়ে সচরাচর প্রচুর লালা বেরোয় অথবা চোখ অস্বাভাবিক লাল হয়ে যায়, বা চোখের মণি স্থির হয়ে যায়। হাত-পা কাঁপতে থাকে। অনেক সময়ে তিনি অচৈতন্য হয়ে যেতে পারেন। অথবা বমি করতে থাকেন। তবে এটাও ঠিক, সব সময়ে উপসর্গ দেখে তাকে বিষক্রিয়ার ঘটনা বলে ধরে নেওয়া বাড়ির লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। ডা. তালুকদার জানাচ্ছেন, যদি দেখে সামান্যতম সন্দেহও হয় যে, অসুস্থতা স্বাভাবিক ঠেকছে না, তবে বাড়িতে না রেখে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালের তরফেই পুলিশকে জানানো হয় এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয়।
চিকিৎসা
বিষের ধরন বোঝার জন্য চিকিৎসকরা সাধারণত রোগীর বমি বা ইউরিন পরীক্ষা করেন। এর পর অ্যান্টিডোট দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। বহু বিষেরই অ্যান্টিডোট এখন হাসপাতালে সহজলভ্য। তাতে কাজ না হলে রোগীর ডায়ালিসিস করা হয়, যাতে রক্ত থেকে বিষ বেরিয়ে যেতে পারে।
করণীয়
বাড়িতেও কিছু বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। অ্যাসিড যদি কেউ খেয়ে ফেলেন, তবে তাঁর শরীরের অভ্যন্তরের অনেকখানি অংশ পুড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তাঁকে জোর করে বমি করানোর চেষ্টা করা যাবে না। বমি করাতে গেলে ফের অ্যাসিড ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত খাদ্যনালি দিয়ে বেরিয়ে আসার পথে আরও বেশি ক্ষতি করবে। যদি কেউ কীটনাশক খেয়ে থাকেন, তবে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা নুন-জল বা কাঁচা ডিম খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করেন। তবে গোড়ায় বুঝতে দেরি হলে সেই বিষ খাদ্যনালির শেষের দিকে চলে যায়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা ওষুধপত্র দেন, যাতে মলের সঙ্গে তা শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। কেরোসিন খেলে আবার বমি করানোর চেষ্টা করা হয় না, কারণ সেটি তখন গলা দিয়ে ফুসফুসে চলে যেতে পারে। বিষের ধরন বুঝে চিকিৎসকরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেন।
বিষক্রিয়া হয়েছে বুঝতে পারলে পরিধেয় জামাকাপড় পাল্টে দিতে হবে। কিছু বিষ পোশাকে অনেকক্ষণ লেগে থাকলে তা চামড়ার মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যাঁরা চাষের কাজে যান, ভিজে কাপড় বা গামছায় নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে। সেফটি গ্লাস দিয়ে ঢাকতে হবে চোখও। খেত থেকে ফিরে জামাকাপড় কেচে স্নান করে নিন। বিষাক্ত ধোঁয়ায় থাকলেও ভাল করে স্নান করে নিতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)