E-Paper

শৈশবেই ডায়াবিটিস, সমাধান-সূত্র গবেষণায়

প্রথম দলটির ২০০ জনকে গর্ভাবস্থার আগের ছ’মাস, গোটা গর্ভাবস্থা এবং তার পর বাচ্চার জন্মের পরেও আরও ছ’মাস বিশেষ যত্নে রাখা হয়। গর্ভাবস্থার আগে থেকেই লক্ষ্য রাখা হয়, যাতে প্রত্যেকে সুসম আহার পান।

সায়ন্তনী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২৫ ০৮:২৬

—প্রতীকী চিত্র।

ভিত যদি মজবুত না হয়, অচিরেই সে বাড়িতে ফাটল ধরবে! মানুষের শরীরস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ঘটে না। বহু সময় দেখা যায়, জন্মের পরে শিশু একটু বড় হতেই তার স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিয়েছে। কারও শরীরের যথাযথ বৃদ্ধি হচ্ছে না, কারও আবার অস্বাভাবিক স্থূলতা, ওজন বাড়ছে মাত্রাছাড়া ভাবে। অনেক বাচ্চা আবার ছোট থেকেই ডায়াবিটিস নয়তো রক্তাল্পতায় আক্রান্ত। এ ধরনের সমস্যা কী ভাবে রোধ করা যায়, আদৌ তা সম্ভব কি না, উত্তরের সন্ধানে শুরু হয়েছিল গবেষণা। সম্প্রতি ‘দ্য জার্নাল অব নিউট্রিশন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাপত্রটি। সমাধান-সূত্রও দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

নয়াদিল্লির ‘সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজ়’, কল্যাণীর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স’ (এনআইবিএমজি)-সহ আরও বেশ কিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান যুক্ত রয়েছে এই গবেষণায়। গবেষণায় আর্থিক সহযোগিতা করেছে হায়দরাবাদের ‘ডিবিটি অ্যান্ড ওয়েলকাম ইন্ডিয়া অ্যালায়েন্স’। এই গবেষণার প্রধান, ‘সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড স্টাডিজ়’-এর ডেপুটি ডিরেক্টর বিজ্ঞানী রণদীপ চৌধুরী জানান, তাঁরা গবেষণার জন্য দিল্লির সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিছু পরিবারকে বেছে নিয়েছিলেন। মা হওয়ার পরিকল্পনা ছিল এমন মোট ৪০০ মহিলাকে যুক্ত করা হয় গবেষণায়। এর মধ্যে ২০০ জনের একটি দলকে গর্ভাবস্থা শুরুর ছ’মাস আগে থেকে যথাযথ যত্নে রাখা হয়েছিল। বাকি ২০০ জনকে এই সুবিধা না দিয়ে তাঁদের নিজস্ব ব্যবস্থায় রেখে দু’টি দলের মধ্যে পার্থক্য কী হচ্ছে, তা পরীক্ষা করার জন্য রাখা হয়েছিল।

প্রথম দলটির ২০০ জনকে গর্ভাবস্থার আগের ছ’মাস, গোটা গর্ভাবস্থা এবং তার পর বাচ্চার জন্মের পরেও আরও ছ’মাস বিশেষ যত্নে রাখা হয়। গর্ভাবস্থার আগে থেকেই লক্ষ্য রাখা হয়, যাতে প্রত্যেকে সুসম আহার পান। যথাযথ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার খাওয়া, পরিশুদ্ধ জল পান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে জোর দেওয়া হয়। এ ছাড়া, শরীরস্বাস্থ্যও নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়। যেমন দেখা হয়, রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া), ডায়াবিটিস, থাইরয়েড রয়েছে কি না। আয়রন ও ফোলিক অ্যাসিডের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট শরীরে কী পরিমাণে উপস্থিত রয়েছে, তা-ও পরীক্ষা করে দেখা হয়। লক্ষ্য ছিল একটাই— নবজাতকের ‘গাট মাইক্রোবায়োম’-কে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। ‘গাট মাইক্রোবায়োম’ হল মানুষের পরিপাকতন্ত্রে, মূলত ইনটেসটাইন বা অন্ত্রে উপস্থিত অণুজীব-জগৎ। এর মধ্যে রয়েছে ভাইরাস, ব্যাক্টিরিয়া, ছত্রাক-সহ অন্য মাইক্রোবস। এই ‘গাট মাইক্রোবায়োম’ মানুষের শরীরস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এরা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে, হজম ক্ষমতা বাড়ায়, খাবার থেকে পুষ্টিগুণ শোষণে সাহায্য করে। এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যেও এর প্রভাব রয়েছে।

রণদীপ জানান, গর্ভাবস্থাতেও অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের প্রতি মাসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়েছিল। ক্যালশিয়াম, ভিটামিন ডি-র মতো সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়, সুসম আহার, পরিশুদ্ধ পানীয় জল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় জোর দেওয়া হয়। একই কাজ করা হয় সন্তান জন্মের পরেও। এর সঙ্গে যোগ করা হয় বাচ্চার যত্ন কী ভাবে নিতে হয়, সেই শিক্ষা দেওয়া এবং শুধুমাত্র বাচ্চাকে স্তন্যপান করানোয় জোর দেওয়া। রণদীপ জানান, এ ভাবে পুরো সময় যত্ন রাখার পরে ছ’মাস বয়সি ৩৯২টি শিশুর মল সংগ্রহ করা হয় এবং দেখা হয় তার শরীরে কী কী ভাল ব্যাক্টিরিয়া রয়েছে। দেখা গিয়েছে, যারা (মা ও শিশু) বিশেষ যত্নে ছিল, সেই সব শিশুর শরীরে খারাপ ব্যাক্টিরিয়ার সংখ্যা কম। বিশেষ করে ‘ক্লেবসিয়েল্লা নিউমোনিয়াই’ যা শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। উল্টো দিকে, ভাল ব্যাক্টিরিয়া যেমন মেগাসফেরা, প্রিভোটেলা, বাইফাইব্যাক্টিরিয়াম ব্রেভ-এর সংখ্যা বেশি। এরা হজম ক্ষমতা বাড়ায়, শরীরের রোগপ্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে, শিশুর শরীরের সঠিক বৃদ্ধি ঘটায়। এই মাইক্রোবায়োম বিশ্লেষণে মূল ভূমিকায় ছিলেন এনআইবিএমজি-র বিজ্ঞানী শৌভিক মুখোপাধ্যায়।

রণদীপ এনআরএস থেকে এমবিবিএস করেছেন। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমডি। পরে পিএইচডি করেন নরওয়ের ‘ইউনিভার্সিটি অব বার্গেন’ থেকে। রণদীপ জানান, এই গবেষণা থেকে স্পষ্ট গর্ভাবস্থার আগে থেকে মা ও পরবর্তীতে মা-শিশু দু’জনের সুস্বাস্থ্য, সুসম আহার, পুষ্টি ও মনের যত্ন নিলে তা সন্তানের ‘গাট মাইক্রোবায়োম’কে শক্তিশালী করে। তাতে শরীরে উপকারি ব্যাক্টিরিয়ার সংখ্যা বাড়ে, খারাপ ব্যাক্টিরিয়ার সংখ্যা কমে। যা দীর্ঘমেয়াদি ভাবে শিশুকে সুস্থ রাখে। জীবনের ভিত মজবুত হয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Diabetes childhood Children Research Nutrition

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy