রান্না শুধু পেট ভরানোর বিষয় নয়, এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে শরীরের যত্নও। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নজর থাকে টাটকা আনাজ ব্যবহারের দিকে, তেল-মশলার মাপ ঠিক রাখার দিকে। কিন্তু রান্নার উপকরণ নিয়ে যতটা ভাবা হয়, ততটা কি ভাবা হয় রান্নার পাত্র নিয়ে? অথচ সেই পাত্রই ঠিক করে দিতে পারে খাবার কতটা নিরাপদ বা ক্ষতিকর হবে।
সাধারণ ভাবে বাড়িতে রান্না ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে স্টেনলেস স্টিল, লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, পিতল, বিভিন্ন ধরনের নন স্টিক পাত্র, কাচ ও চিনামাটির পাত্র। সাম্প্রতিক বেশ কিছু বছর ধরে মেলামাইনের পাত্রে পরিবেশন ও প্লাস্টিকের পাত্রে মাইক্রোওয়েভে রান্না বা খাবার গরম করার চল বেড়েছে। কিন্তু এগুলো ব্যবহার কতটা স্বাস্থ্যকর?
- স্টেনলেস স্টিল: রান্নার বাসন হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য হল স্টিলের বাসন। এই বাসনে খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া হয় না। টক জাতীয় খাবারও এই পাত্রে রেখে দিলে সমস্যা নেই। তাপ সঞ্চালনও ভাল হওয়ার জন্য রান্না তাড়াতাড়ি হয়। তবে নিম্নমানের স্টিল থেকে সামান্য নিকেল বা ক্রোমিয়াম খাবারে মিশে যেতে পারে। তাই মোটা তলদেশ ও ভাল মানের পাত্র ব্যবহার করা দরকার।
- অ্যালুমিনিয়াম: দেশের বেশির ভাগ রান্নাঘরেই অ্যালুমিনিয়ামের কড়াই, হাঁড়ি দেখা যায়। কারণ এই বাসনের দাম কম, ওজনেও হালকা। তাপ দ্রুত ছড়ানোর জন্য রান্নাও ভাল হয়। তবে সমস্যাও আছে। টক বা নোনতা খাবার অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সামান্য পরিমাণ ধাতু খাবারে মিশিয়ে দিতে পারে। তাই টক জাতীয় খাবার অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রান্না করা বা রাখা এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। উচ্চ তাপমাত্রায় এই ধাতু খাবারেও মিশতে পারে। এমনকি খাবার মুড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ব্যবহার করা হয়, তাতেও খাবারের তাপমাত্রা নিয়ে সতর্ক হতে হবে। খাবার কিছুটা ঠান্ডা হলে তবেই ফয়েলে মোড়া উচিত।
- তামা ও পিতল: তামার পাত্রে জল রাখার চল আছে। জল বা শুকনো খাবার রাখায় সমস্যা নেই। তামার পাত্রে রান্নার সময়ে খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করতে পারে, বিশেষত খাবার যদি টক বা লবণযুক্ত হয়। বিক্রিয়ার ফলে খাবারের পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়। তবে এই পাত্রে ভাত বা ডালের মতো খাবার রান্না করা যেতে পারে। পিতলের ক্ষেত্রেও টক ও লবণযুক্ত কিছু রান্না করার ফলে ধাতু খাবারের সঙ্গে মিশতে পারে। পিতল যেহেতু দস্তা ও তামার মিশ্রণে তৈরি, বহু দিন ধরে এই দুই ধাতু খাবারের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলে, তা থেকে দেখা দিতে পারে একাধিক সমস্যা।
- নন-স্টিক: কম তেলে রান্না হয়, সহজে পরিষ্কার করা যায়। এর জন্যই নন-স্টিক বাসনের জনপ্রিয়তা। কিন্তু এই ধরনের বাসনে যে টেফলন কোটিং থাকে, তা অতিরিক্ত তাপে ক্ষতিকর ধোঁয়া তৈরি করতে পারে। আর কোটিংয়ে আঁচড় পড়ে গেলে সেই কণাই খাবারে মিশে যেতে পারে। তাই নন-স্টিকে রান্নার সময়ে কিছু জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। যেমন মাঝারি আঁচে রান্না, কাঠের খুন্তির ব্যবহার ও কোটিং উঠে গেলে পাত্রটি বদলে ফেলা।
- কাচ ও চিনামাটি: এই বাসন রাসায়নিক ভাবে প্রায় নিষ্ক্রিয়, তাই টক-ঝাল-লবণাক্ত, সব রান্নাই নিরাপদ। মাইক্রোওয়েভ বা ওটিজি-তে রান্না হোক বা পুনরায় খাবার গরম করা, এই দুইয়ের বিকল্প নেই।
- লোহার কড়াই: পুরনো দিনের লোহা বা কাস্ট আয়রনের পাত্র আবার ফিরছে পছন্দের তালিকায়। এতে রান্না করলে খাবারে সামান্য লোহা মেশে, তাতে সমস্যা নেই। তবে রান্নার পরে ঠিক মতো না রাখলে মরচে ধরতে পারে। টক খাবার রান্না করে লোহার পাত্রে দীর্ঘক্ষণ না রাখাই ভাল।
- মেলামাইন ও প্লাস্টিক: দেখতে সুন্দর, হালকা, সহজে ভাঙে না। কিন্তু মেলামাইন উচ্চ তাপে গরম হলে ফরম্যালডিহাইড নামের ক্ষতিকর রাসায়নিক বেরোতে পারে। মাইক্রোওয়েভে ব্যবহারের উপযুক্ত প্লাস্টিক পাত্রও গরম হয়ে বিপিএ নামের রাসায়নিক তৈরি করে। তা ছাড়া রয়েছে মাইক্রো-প্লাস্টিক দেহে ঢোকার ভয়। এই ধরনের পাত্র এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।
বিশেষজ্ঞের মত
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলছেন, “তামা, লোহা, দস্তা বাসন থেকে সামান্য পরিমাণে দেহে ঢুকলেও সমস্যা কম, কারণ দেহে সেগুলির প্রয়োজনও রয়েছে। কিন্তু সীসা, অ্যালুমিনিয়ামের মতো ভারী ধাতু দেহের পক্ষে ক্ষতিকর। দীর্ঘ দিন ধরে এই ধাতু দেহে ঢুকলে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। প্রভাব পড়তে পারে মস্তিষ্কের কার্যপদ্ধতিতেও। এটি গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্যও ক্ষতিকর। এমনকি পার্কিনসনিজ়ম, অ্যালঝাইমার্সের মতো রোগেও এই ধাতব-বিষক্রিয়ার প্রভাব রয়েছে বলে বর্তমানে চিকিৎসকেরা মনে করছেন। অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে উচ্চ তাপমাত্রায় রান্নার সময়ে রাসায়নিক বিক্রিয়ার আশঙ্কা বেশি। যদিও ভাল মানের অ্যানোডাইজ়ড অ্যালুমিনিয়ামের বাসনে একটি আবরণ থাকে, যা এই আশঙ্কা অনেকটাই কমায়।” তিনি জানাচ্ছেন, নন-স্টিক পাত্র কম আঁচে ব্যবহার করতে হবে। টেফলনের আবরণ উঠে যেতে শুরু করলে তৎক্ষণাৎ তা বাদ দেওয়া দরকার।
পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘খাবারে ক্ষতিকর ধাতু-রাসায়নিক মিশতে পারে অনেক রকমের বাসন থেকেই। রোজকার ব্যবহারের উপযোগী, অথচ দাম সাধ্যের মধ্যে, এমন বাসনের জন্য স্টিলের বিকল্প নেই। আর বেকিং, গ্রিলিংয়ের জন্য কাচ, চিনামাটির পাত্র সবচেয়ে ভাল। প্লাস্টিক ও মেলামাইন একদম এড়িয়ে চলাই উচিত।’’
রান্নাঘরের প্রতিটি পাত্র আসলে আমাদের স্বাস্থ্য ভাল রাখার নীরব সহযোগী। তাই কেবল সুদৃশ্য বাসনের ফাঁদে পা না দিয়ে বুঝেশুনে রান্নার পাত্র বেছে নেওয়া দীর্ঘ মেয়াদে লাভজনক।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)