E-Paper

দিশেহারা হবেন না

ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজ়েশন ও ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অরগানাইজ়েশনের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের স্ট্রোক হবে! তা সত্ত্বেও স্ট্রোক নিয়ে সচেতনতার অভাব যথেষ্ট।

ঊর্মি নাথ 

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:৩৬

গভীর রাতে বা নির্জন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা অন্য শারীরিক সমস্যা হয়েছে এমন নজির অনেক। হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে আশপাশের লোকজনের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তখন মাথা ঠান্ডা রেখে দ্রুত কী ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে, জেনে নিন।

স্ট্রোক ও হাইপোগ্লাইসেমিয়া

ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজ়েশন ও ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অরগানাইজ়েশনের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যার প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের স্ট্রোক হবে! তা সত্ত্বেও স্ট্রোক নিয়ে সচেতনতার অভাব যথেষ্ট। ব্রেন ইসকিমিয়া বা ব্রেন হ্যামারেজ, স্ট্রোক হঠাৎই হয়। স্ট্রোক হয়েছে কি না বোঝার জন্য ‘BEFAST’ সূত্রটি মনে রাখুন। বি-ব্যালান্স বা ভারসাম্য। ব্যক্তি হাঁটতে গিয়ে ভারসাম্য হারাবেন, দাঁড়াতে গেলে মাথা ঘুরবে। ই-আই বা চোখ। দৃষ্টি হঠাৎ চলে যেতে পারে বা ডাবল ভিশন হতে পারে। এফ-ফেস বা মুখ। কথা বলতে বা হাসতে গিয়ে মুখ এক দিকে বেঁকে যাবে। এ-আর্ম বা হাত। হাত তুলতে জোর পাবেন না। যে কোনও একটা হাত অচল হয়ে যাবে। এস-স্পিচ বা কথা। কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে যাবে বা কথা বন্ধ হয়ে যাবে। টি-টাইম বা সময়। দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া। একটি বা একাধিক লক্ষণ কারও মধ্যে দেখা দিলে বুঝতে হবে তাঁর স্ট্রোক হয়েছে। ‘‘স্ট্রোক হলে বাড়িতে চিকিৎসক ডেকে সময় নষ্ট করবেন না। যত দ্রুত রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা পাবেন, তত তাড়াতাড়ি তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। এর বিকল্প নেই। স্ট্রোকের ফলে প্রতি সেকেন্ডে ৩২ হাজার ব্রেনসেলের মৃত্যু হয়। স্ট্রোক ঘটে যাওয়ার দু’ থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে পারলে বেঁচে যাওয়া ব্রেনসেলগুলোর কাজ শুরু করানো সম্ভব। তিন ঘণ্টার পর থেকে বেনিফিট কমতে থাকে। অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়ি ডাকতে যে সময় লাগে, তার মধ্যে রোগীকে ওষুধ, জল, গ্লুকোজ কোনও কিছু খাওয়ানো যাবে না। এই সময় প্যারালিসিস ডেভেলপ করে। মুখে যা দেবেন তা গলায় আটকে যেতে পারে। তাই রোগীকে শুইয়ে রাখলে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে রাখতে হবে, না হলে মুখের লালা গলায় গিয়ে আটকাতে পারে। এই সময়ে নাইট্রেট জাতীয় ওষুধ (সরবিট্রেট) দেবেন না। এতে বিপি আরও নেমে যাবে,’’ বললেন নিউরোলজিস্ট ও স্ট্রোক স্পেশ্যালিস্ট ডা. জয়ন্ত রায়। বরং এ সময়ে রোগীর রক্তচাপ মেপে এবং তিনি যে ওষুধ খান তাঁর একটি তালিকা বানিয়ে রাখুন। রোগী ডায়াবেটিক হলে বাড়িতে গ্লুকোমিটার থাকলে সুগার চেক করে রাখুন। ‘‘ডায়াবেটিকদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। যার লক্ষণও স্ট্রোকের মতো। তবে হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় রোগী খাওয়া বা কথা বলার মতো অবস্থায় থাকলে, তখন তাঁকে গ্লুকোজ জল দিতে পারেন। দিলেই দেখবেন স্বাভাবিক হয়ে যাবেন,’’ বললেন ডা. রায়। আগাম সচেতন হওয়ার জন্য ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অরগানাইজেশন প্রস্তুত করছে স্ট্রোক রিস্কো মিটার অ্যাপ। যেখানে নিজের শরীর সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য দিলে অ্যাপ বলে দেবে আপনার পাঁচ থেকে ১০ বছরের মধ্যে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। এতে সচেতন থাকা যায়। মনে রাখবেন, সব হাসপাতালে স্ট্রোকের চিকিৎসা হওয়ার মতো পরিষেবা নেই। স্ট্রোকে নিউরোলজিক্যাল সার্পোট প্রয়োজন। তাই রোগী ভর্তির আগে জানতে হবে হাসপাতালটি ‘স্ট্রোক রেডি’ হাসপাতাল কি না!

হার্ট অ্যাটাক

বুকে ব্যথা মানেই হার্ট অ্যাটাক নয়। ব্যথার ধরন বুঝতে হবে। বুকের মাঝখানে বা বাঁ দিকে আধ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ব্যথা, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট ও অতিরিক্ত ঘাম হলে, বুঝতে হবে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ‘‘এই পরিস্থিতিতে রোগী যে অবস্থায় কমফর্ট ফিল করবেন সেই পোজিশনে রাখতে হবে। তবে শুয়ে দিলেই ভাল। শ্বাসকষ্ট হলে বসে যদি আরাম বোধ করেন তা হলে বসানো যায়। ঘরে যদি অক্সিজেন ক্যান থাকে, সেটা প্রয়োগ করতে পারেন। এ সময়ে দূরে বড় হাসপাতালের চেয়ে কাছে যে নার্সিংহোম বা হাসপাতাল রয়েছে, সেখানে দ্রুত নিয়ে যাওয়া উচিত। সেখানে একটা ইসিজি হলে পরিস্থিতি বোঝা যাবে ও চিকিৎসা শুরু করা যাবে,’’ বললেন কার্ডিয়োলজিস্ট ডা. সুনীলবরণ রায়। হার্ট অ্যাটাক সামাল দিতে জিভের তলায় নাইট্রেট জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে ডা. রায়ের পরামর্শ, ‘‘হার্ট অ্যাটাক হলে অনেকের ব্লাডপ্রেশার কমে যায়। তখন নাইট্রেট জাতীয় ওষুধ দিলে বিপি আরও কমে যাবে, বিপদ বাড়বে। এর বদলে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে। এখন প্রায় সব বাড়িতে পালস অক্সিমিটার ও ব্লাড প্রেশার মাপার যন্ত্র থাকে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে মনে হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্লাড প্রেশার, পালস রেট ও অক্সিজেনের মাত্রা মেপে নিন। বিপি কম থাকলে শুয়ে থাকা মানুষটির পা উপরের দিকে করে ধরে রাখতে হবে। যদি দেখা যায় প্রেশার মোটামুটি ঠিক আছে তখন নাইট্রেট জাতীয় ওষুধ দেওয়া যায়।’’

পুড়ে গেলে

রান্নার সময়ে, গরম খাবার পড়ে গিয়ে পুড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ‘‘পুড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে জল দিন। অনেকে জল দিতে ভয় পান। কিন্তু জল দেওয়ার সঙ্গে ফোস্কা পড়ার সম্পর্ক নেই। ফোস্কা পড়ে আমাদের কোষীয় তরল জমা হয়ে। ফোস্কার জল সিরিঞ্জ দিয়ে বার করে দেওয়া যায়। কিন্তু ফোস্কার উপরের চামড়া উঠে গেলে ইনফেকশনের সম্ভাবনা থাকে। পুড়ে যাওয়া অংশে সিলভার সমৃদ্ধ জেল পরিষ্কার আঙুলে করে হালকা করে লাগিয়ে দেবেন, ঘষবেন না বা তুলো ব্যবহার করবেন না,’’ বললেন ডা. সুবীর মণ্ডল। ছোটখাটো পুড়ে যাওয়া সামলে নেওয়া যায়। ‘‘কিন্তু ৪০ শতাংশ বার্ন ইনজুরি হলে বাঁচানো মুশকিল। তখন দ্রুত নরম কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে ইমার্জেন্সিতে যেতে হবে। চটপট চিকিৎসা শুরু না করলে ব্যাকটিরিয়া দেহে প্রবেশ করতে থাকে। তা ছাড়া ত্বক পুড়ে যাওয়ায় দেহে তরলের বাষ্পায়নের ফলে ডিহাইড্রেশন ঘটে। এই জন্য বার্ন পেশেন্টদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন চালু করতে হয়,’’ বললেন ডা. মণ্ডল।

পড়ে গিয়ে চোট লাগলে

হঠাৎ পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে স্বাস্থকেন্দ্রে যাওয়ার আগে কী করবেন? অর্থোপেডিক ডা. সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘খারাপ পজিশনে হাত, পা থাকলে সাবধানে স্বাভাবিক পজিশনে আনতে হবে, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে নরম্যাল অ্যানাটমিক্যাল পজিশন। সারভাইক্যাল স্পাইনে কিছু হয়ে গেলে জটিলতা বাড়ে, তাই ঘাড়ের তলায় খবরের কাগজ ভাঁজ করে রাবারব্যান্ড দিয়ে কলারের মতো পরিয়ে রাখতে হবে, যাতে নড়াচড়া করতে না পারেন। চিৎ করে শুইয়ে রাখার সময়ে মাথার দু’পাশে বালিশ রাখুন। চিকিৎসক দেখানোর আগে পর্যন্ত মুখে জল বা খাবার দেওয়া চলবে না। পা বা হাত মচকে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মচকানো জায়গায় বরফ দিন। পা মচকে গেলে পায়ের তলায় বালিশ দেবেন। হাতে লাগলে কাপড়, ওড়না বা গামছা দিয়ে ট্রায়াঙ্গুলার স্লিং করে হাত বিশ্রামে রাখুন। বরফ দেওয়ার পরে পেন রিলিফ মলম লাগাতে পারেন, মালিশ নয়।’’

কয়েকটি সচেতনতা

বাথরুমে পিছলে পড়ে যাওয়ার ঘটনা বিরল নয়। ‘‘ইউরিন পাসের পরে বিপি কমে যায়, একটা বিশেষ প্রকারের রক্তচাপের ওষুধ নিলে তা বেশি হয়। তাই কমোড থেকে সাবধানে উঠে দাঁড়ান। বাথরুম যত ছোট হয় তত ভাল, পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে দুটো হাত প্রসারিত করে দুটো দেওয়াল ধরতে পারলে মাথায়, কোমরে চোট লাগার আশঙ্কা থাকে না। প্রয়োজনে পারিবারিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। পারিবারিক চিকিৎসককে যেন আপৎকালীন সময়ে দ্রুত পাওয়া যায়,” বললেন ডা. মণ্ডল।

শরীরের কোনও অংশ কেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে থাকলে পরিষ্কার ও পর্যাপ্ত তুলো দিয়ে কাটা জায়গাটা চেপে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। রোগী ডায়াবেটিক হলে বা রক্ত পাতলা করার ওষুধ খেলে সে কথা চিকিৎসককে জানাতে হবে।

প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্কর রিকভারি পজিশন, মাউথ টু মাউথ ব্রিদিং, আর্টিফিশিয়াল পাম্পিং এবং গলার মধ্যে কিছু আটকে গেলে তা বার করার জন্য হেমলিক ম্যানুভার সম্পর্কে জেনে রাখা উচিত।

উচ্চ রক্তচাপ, কম ঘুম, মানসিক চাপ, শারীরচর্চার অভাব, অতিরিক্ত মদ্যপান ও ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। পরিবারে স্ট্রোকের ইতিহাস থাকলেও সম্ভাবনা থাকে। তাই তিরিশের পর থেকে বছরে অন্তত একবার চেকআপ করানো উচিত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Heart Attack Burn

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy