Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Attractive Voice

স্বর সংলাপ

প্রত্যেকটি মানুষের স্বরেই তাকে ভিন্নতর মাত্রা দেওয়ার উপযুক্ত উপাদান থাকে। নিয়মিত স্বর চর্চার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব আকর্ষক কণ্ঠস্বর।

Sourced by the ABP

কোয়েনা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৪৭
Share: Save:

সাল ১৯৮৩। বছরের মাঝামাঝি নাগাদ মঞ্চে এল ‘নাথবতী অনাথবৎ’। একক নাটক। মহাভারতের এক-একটি চরিত্র, এক-এক রকম স্বরক্ষেপণ, ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে মঞ্চে মূর্ত হয়ে উঠতে লাগলেন শাঁওলী মিত্র। তিনি কখনও যুধিষ্ঠির, কখনও বা দ্রৌপদী। যেমন স্বাভাবিক তাঁর কণ্ঠস্বর, তেমনই তাঁর বাচনভঙ্গি। স্বর নিয়ন্ত্রণে তাঁর দক্ষতা দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল।

পিছিয়ে যাই আরও কয়েকটি বছর। তখন বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। সেই খবর আকাশবাণী কলকাতা থেকে সংবাদ পরিক্রমায় পড়তেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রচারটির বিষয়গত আবেগ ছাড়াও তাঁর কণ্ঠ, উপস্থাপনা মুগ্ধ করত শ্রোতাদের।

আকর্ষক এই কণ্ঠস্বর কি জন্মগত, নাকি তৈরি করা সম্ভব? ব্রততী বন্দোপাধ্যায় বলছেন, “দৈনন্দিন কথাবার্তার সময়ে আবেগ, অনুভূতি মিশিয়ে আমরা খুব স্বাভাবিক ভাবে যে কথা বলি, তাই যখন কবিতা, গান, কিংবা অভিনয়ের মঞ্চে ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় ভয়েস মডিউলেশন বা স্বর নিয়ন্ত্রণ। নিয়মিত কণ্ঠচর্চার মাধ্যমে সেই কাঙ্ক্ষিত স্বরের প্রক্ষেপণ সম্ভব।”

আজকাল অনেক মা-বাবাই চান কেবল পুঁথিগত বিদ্যা নয়, সন্তানের কিছু সৃজনশীল গুণও থাকুক। ছোট বয়সে তাই গান, আবৃত্তিতে ভর্তি করেন। স্বপ্ন দেখেন তাঁর সন্তানও রিয়্যালিটি শোয়ে অংশ নেবে। তেমন একটু বড় হলে অনেকেই নাটক শেখেন। নিয়মিত অনুষ্ঠানও করেন। কিন্তু মঞ্চে তাঁদের গলার স্বর দর্শকের হৃদয় যেন ঠিক তেমন করে ছুঁতে পারে না। খামতি যে ঠিক কোথায়, তা বুঝে পান না অনেকেই। জয়তী চক্রবর্তী বলছেন, “আদতে তা স্বর চর্চার অভাব।” যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্লগিং করেন অনেকে। কিন্তু সব ব্লগারের কথা কি শুনতে ভাল লাগে? নিউজ় রিডার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন অনেকে। কাঠখোট্টা খবর পড়লে কিন্তু তা হৃদয়গ্রাহী হবে না। ঠিক তেমনই অভিনেতা হতে শুধু অভিনয় জানলেই হবে না। তাঁদের প্রত্যেকেরই স্বর চর্চা করা প্রয়োজন।

শিক্ষা শুরুর বয়স

অবশ্য স্বর চর্চা প্রয়োজন বলেই একেবারে শিশু বয়স থেকে কিন্তু আপনার সন্তানকে সেই দিকে ঠেলে দেবেন না। এতে অনেক সময়েই তারা শিল্পচর্চায় আগ্রহ হারায়। ছোট বাচ্চারা আজকাল নানা রিয়্যালিটি শোয়ে অংশ নেয়, গান গায়। জয়তী বলছেন, “সুরের উপর এদের দখল কিন্তু ঈশ্বরপ্রদত্ত গুণ। তা বিচার্য নয়। বরং একটু বয়স বাড়লে, বোধ তৈরি হলে তবেই স্বর চর্চা করা উচিত।” সাধারণ ভাবে বয়ঃসন্ধিতে ছেলেদের গলা ভাঙে, স্বরের বদল হয়। সেই সময়টা পেরিয়ে গিয়ে কণ্ঠচর্চা শুরু করা ভাল। মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিতে সব সময় গলার পরিবর্তন না ঘটলেও, অন্তত বোধ আসার পরেই চর্চা শুরু করা দরকার।

স্বর চর্চা

বিষয়টা শুনতে কঠিন হলেও, আদতে কাজটা সহজ। বাচিক শিল্পী সুমন্ত্র সেনগুপ্তের কথায়, প্রত্যেকটি মানুষের স্বরেই মডিউলেশন করার উপযুক্ত উপাদান থাকে। চর্চায় তার প্রকাশ ঘটে। সহজ কথায়, গান, কবিতা বা নাটকে সংলাপ অনুযায়ী কণ্ঠের আরোহণ-অবরোহণই হল ‘ভয়েস মডিউলেশন’। স্বরের তীক্ষ্ণতা ও তীব্রতার পরিবর্তন ঘটিয়ে এই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর জন্য স্কেলের সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরি। স্বরের মূল স্কেল সাতটি। তবে নিয়মিত অনুশীলনে আরও বেশ কয়েকটি স্কেলে যাওয়া যায়। অর্থাৎ ঊর্ধ্ব সা এর পরেও সা-তে যাওয়া যায়, আবার নিম্ন সা এর পরে পরবর্তী সা-এও আসা যায়।

এই চর্চার দুটি দিক— একটি স্বরের কারিকুরি, প্রয়োগকৌশলগত দিক যা নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে, বিশেষ কিছু লেসন ব্যবহার করে গুরুরা শেখাতে পারেন। অন্যটি হল উপলব্ধিগত দিক।

    প্রয়োজন কিছুটা বুদ্ধিমত্তা এবং বোধও। শিল্পীদের সকলের মতেই, সাতটি বা তার বেশি স্কেলে কণ্ঠস্বর পৌঁছতে পারলেও, কখন, কোথায়, কোন স্বর ব্যবহার হবে, সেই বোধ থাকা জরুরি। সেতারের যে তারে আঘাত করলে সুর ওঠে, তার নীচে অনেক সূক্ষ্ম তার থাকে, সেগুলি অনুরণন তৈরি করে। মানুষের মধ্যেও সে রকম সূক্ষ্ম অনুভূতির তার থাকে, যার চর্চা জরুরি।

    সুমন্ত্র বলছেন, “শিল্পী মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বর সংলাপের দ্বারা মুহূর্তের মধ্যে একটা বিশ্বাসের জন্ম দেন। কেবল টেকনিক্যালিটি দিয়ে সেই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। প্রয়োজন আবেগ-অনুভূতি। আর তা ফুটিয়ে তলতে মানুষ ও প্রকৃতি উভয়কে নিবিরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে ও ভালবাসতে হবে।”

      টেকনিক্যালিটি, অনুভূতি এ সবের সঙ্গে উচ্চারিত শব্দে প্রাণ থাকাও জরুরি। শহর-শহরতলিতে বসবাসকারী মানুষ, যারা সভ্যতার বহু সুযোগসুবিধার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে, অভিনয়ের খাতিরে তাদের বিপরীত শ্রেণিতে অবস্থিত মানুষের ছবি ফুটিয়ে তুলতে হল। সে ক্ষেত্রে শব্দে অনুভূতিটুকু না থাকলে, সে অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য হবে না। তবে এই প্রাণ প্রতিষ্ঠা কিন্তু শেখানো যায় না। তা প্রতিটি মানুষের জীবন চর্চা, সামাজিক ও রাজনৈতিক বোধ, তার দর্শন, কল্পনাপ্রবণতা ও অনুভূতিশীলতার উপর নির্ভর করে।

      আর কী শিখতে পারেন?

      সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ়, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ়ের মতো শব্দ বা ধ্বনিরও একটা আলাদা ভাষা আছে। ব্রততী বলছেন, “এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে আমরা যে ভাবে ‘আঃ’ বলব, পায়ে কাঁটা ফুটলে বা কারও উপর বিরক্ত হলে সে ভাবে বলব না।” তাই, শব্দের মর্মার্থ বুঝে তার উচ্চারণব্যঞ্জনা নির্ধারণ করতে হবে। স্বরের ঠিক কোন পিচ ব্যবহারে শ্রোতার কাছে শব্দের ছবি সঠিক অর্থে পরিস্ফুট হবে, তা বুঝতে হবে। সঙ্গে শ্বাসনিয়ন্ত্রণও জরুরি। দীর্ঘ পঙ্‌ক্তি উচ্চারণের সময় শ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, শ্রোতার কানে আঘাত লাগে।

      এই মডিউলেশন, কিন্তু একদিনে শেখা সম্ভব না। এর নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতিও হয় না। দীর্ঘ দিন স্বরচর্চার মধ্যে দিয়েই রাগ, দুঃখ, আনন্দ প্রতিটি অনুভূতিকে সংযত ভাবে গলায় তুলে আনতে হয়। টেকনিক্যাল স্কিল বা দর্শন, বোধ কোনও একটি দিয়ে শ্রোতাকে ছোঁয়া যায় না। অতিরিক্ত টেকনিক্যালিটি স্বরের নিজস্বতাকেও নষ্ট করে। তাই এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই একজন সার্থক শিল্পী হয়ে উঠতে পারেন। আপনার শিল্প চর্চাকে পৌঁছে দিতে পারেন শ্রোতার হৃদয়ের কাছাকাছি। শিল্পীদের প্রত্যেকের মতেই, এ শিক্ষা হাতে ধরে দেওয়া যায় না, এ কিছুটা অন্তরের উপলব্ধি, বাকিটা অভ্যেস।

      কোয়েনা
      দাশগুপ্ত

      (সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

      অন্য বিষয়গুলি:

      Lifestyle
      সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
      Advertisement
      Advertisement

      Share this article

      CLOSE