পড়ুয়াদের আন্দোলনে ‘উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগে প্রায় দু’বছর ধরে সাসপেনশনে থাকা বাঙালি অধ্যাপক স্নেহাশিস ভট্টাচার্যকে বহিষ্কার করেছে দিল্লির সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়। এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করে এ বার ‘সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিয়োনাল কোঅপারেশন’ (সার্ক)-কে চিঠি লিখলেন বিশ্বের ৩০০ জন অধ্যাপক-গবেষক। তাঁদের বক্তব্য, যে ভাবে স্নেহাশিসকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তা অন্যায্য। এ ব্যাপারে সার্কই হস্তক্ষেপ করে স্নেহাশিসকে চাকরিতে ফেরানোর ব্যবস্থা করুক।
সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিয়োনাল কোঅপারেশন (সার্ক)-ভুক্ত দেশগুলি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষক। আগে দিল্লির চাণক্যপুরীতে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখন ময়দানগঢ়হিতে। বিতর্কের সূত্রপাত ২০২২ সালে। বৃত্তির অঙ্ক বাড়ানোর দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাংশ পড়ুয়া। তাঁদের আরও একটি দাবি ছিল। তা হল, হেনস্থার ঘটনায় বিচারের জন্য তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটিতে পড়ুয়াদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে। পড়ুয়াদেপ সেই আন্দোলন পুলিশ ডেকে তোলানোর অভিযোগ উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনার নিন্দা করে যাঁরা সরব হয়েছিলেন, তাঁদেরই এক জন ছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক স্নেহাশিস। এর জন্য প্রথমে সাসপেন্ড এবং পরে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে বহিষ্কারও করা হয় তাঁকে।
বিশ্ববিদ্যাল়য়ের এই সিদ্ধান্তকে ‘প্রতিহিংসামূলক’ বলে আখ্যা দিয়ে কর্তৃপক্ষকে আগেই চিঠি দিয়েছিল অধ্যাপকদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিজ় টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনস’। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট (উপাচার্যের সমতুল্য পদ) এবং কার্যনির্বাহী পরিষদকে চিঠি লিখেছিলেন ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্থনীতি বিভাগের ১০১ জন প্রাক্তনীও। এ বার সরাসরি সার্কের দ্বারস্থ মোট ৩০৫ জন গবেষক। তাঁদের কেউ দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, কেউ কেউ আবার আমেরিকা এবং ব্রিটেনের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁদের বক্তব্য, নিয়ম মেনে স্নেহাশিসকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেননি কর্তৃপক্ষ। তদন্তও পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। শুধুমাত্র ক্ষমা না চাওয়ার কারণেই তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সাসপেন্ড হওয়ার পরেই দিল্লি হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বাঙালি অধ্যাপক। দিল্লি হাই কোর্টের একক বেঞ্চ সেই সময় জানিয়েছিল, যে হেতু সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, তাই এ বিষয়ে মামলা শোনার এক্তিয়ার নেই তাদের। এর বিরুদ্ধে দিল্লি হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হয়েছিলেন স্নেহাশিস। এই মামলা বিচারাধীন থাকাকালীনই বহিষ্কার করা হয় স্নেহাশিসকে। পরে মামলার শুনানিতে উচ্চ আদালতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানান, সার্ক চুক্তি মেনে ভারতের সংসদে পাশ হওয়া আইনের আওতায় সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল। এ ব্যাপারে ভারত সরকার পরবর্তী কালে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছিল। সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কিছু রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে। যার অর্থ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা শোনার এক্তিয়ার নেই কোনও ভারতীয় আদালতের।
পাল্টা স্নেহাশিসদের যুক্তি ছিল, ভারত সরকার সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়কে কেবল সম্পত্তি বা তহবিল সংক্রান্ত বিষয়ে রক্ষাকবচ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও রক্ষাকবচ দেওয়া হয়নি। আর যে হেতু ভারতীয় আইনেই সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত, তাই তাদের ভারতীয় সংবিধান মেনেই চলতে হবে। সেই কারণে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২৬ মেনে হাই কোর্ট এই মামলা শুনতে পারে।
বাঙালি অধ্যাপকের আরও বক্তব্য, অনুচ্ছেদ ২২৬ ভারতীয় সংবিধানের মূল কাঠামোর অঙ্গ। এমনকি ভারতীয় সংসদও পারে না এই নিয়মের বদল ঘটাতে। তা ছাড়া কোনও ভারতীয় আদালতের যদি এক্তিয়ার না থাকে, তা হলে কর্মচারীদের সমস্যার সুরাহা হবে কী ভাবে? দিল্লি হাই কোর্টে এই মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী ১৮ নভেম্বর।