অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে কোণঠাসা মুহাম্মদ ইউনূস। কিন্তু তাঁর পদত্যাগ করার প্রচারকে এখনও পর্যন্ত ‘নাটক’ বলেই মনে করছে নয়াদিল্লির একটা বড় অংশ। তাদের বক্তব্য, ছাত্র নেতা ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন আরও বেশি করে নিজের পক্ষে টেনে এবং তাদের একজোট করে যত দিন সম্ভব ক্ষমতা ধরে রাখার উদ্দেশ্য ইউনূসের। তাই পদত্যাগ নিয়ে প্রচার একটি ‘কৌশল’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
সূত্রের বক্তব্য, জামায়াতে ইসলামীও জানে, ইউনূস পদত্যাগ করলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। ক্ষুব্ধ বিএনপি রাস্তায় নামলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। গত দেড় দশকে তাদের সংগঠনের কোমর ভেঙে দিয়েছে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। তাই বাংলাদেশে জমানা পরিবর্তনের পরে শীর্ষ জামায়াতে নেতারা বলেছিলেন, ২০০৯ সালের পরে তাঁরা প্রথম ২০২৪ সালের অগস্টে নিজেদের অফিসের তালা খুলতে পারলেন। এ হেন জামায়াতে এখনও বাংলাদেশের মূল স্রোতের রাজনীতিতে আসার মতো সংগঠন বা শক্তি তৈরি করে উঠতে পারেনি, তাদের গুছিয়ে উঠতে আরও অনেক সময় লাগবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
কেন এমন করলেন ইউনূস? সূত্রের খবর, বাংলাদেশের সেনা এবং বিএনপি দ্রুত নির্বাচন ঘোষণার জন্য চাপ বাড়াচ্ছে ইউনূসের উপরে। সূত্রের মতে, ইউনূস চাইছেন অন্তত দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবেও টিকে থাকতে। তবে এটাও ঠিক, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ়-জামানের সঙ্গে সম্মুখ সংঘাতের জায়গায় চলে এসেছেন ইউনূস এবং তাঁর অন্তর্বর্তী সরকার।
ফলে আগামী দিনে সে দেশের রাজনীতি কোন দিকে বাঁক নেয়, তা এখনই চূড়ান্ত হিসাবে ধরে নেওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
সূত্রের খবর, পরিস্থিতি জটিল হওয়ার পিছনে নির্দিষ্ট কারণও রয়েছে। ওই সূত্রেরই দাবি, বেশ কিছু দিন ধরেই সেনাপ্রধান ওয়াকার-কে সরিয়ে দিতে একটি পরিকল্পনা চলছিল অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরে বাংলাদেশ সেনার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার করা হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানকে। পাকিস্তান-পন্থী হিসেবে পরিচিত এই কামরুল আসার পরে তাঁর উদ্যোগে ঢাকায় আইএসআই-এর প্রতিনিধিদল সফর করে এবং পাক নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার চেষ্টা শুরু হয়। সূত্রের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য ছিল ওয়াকারকে সরিয়ে কামরুলকে সেনাপ্রধান করা। ওয়াকারকে সরানোর জন্য চিঠিও তৈরি হয়ে গিয়েছিল বলে খবর। এই কাজে কামরুলের পাশাপাশি যাঁর উপর নির্ভর করা হচ্ছিল, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।
রাজনৈতিক সূত্রের মতে, ওয়াকার-উজ়-জামান এই ষড়যন্ত্র টের পেয়ে যান। বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করে এক দিকে তিনি নিজের শক্তিকে যাচাই করে নিতে চেয়েছিলেন। পাশাপাশি এই বার্তাও অন্তর্বর্তী সরকারকে দিতে চেয়েছিলেন যে, তিনি সরবেন না। সেনার শীর্ষ এবং মধ্য পর্যায়ের নেতৃত্বের সমর্থনও যে তাঁর সঙ্গে রয়েছে, এই বার্তাও তিনি দেন। সেই সঙ্গে দ্রুত নির্বাচন করার চাপ দেওয়া শুরু করেছেন তিনি। এখন দেখার, সেই চাপ ওয়াকার কত দিন কার্যকরী ভাবে ধরে রাখতে পারেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, বিএনপি এখন কোন পথে হাঁটে এবং কী ভাবে দ্রুত নির্বাচনের জন্য ইউনূস সরকারকে বাধ্য করে, তার উপরেও সে দেশের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নির্ভর করছে। এর মধ্যেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার সরাসরি জাতীয় সংসদের ভোট পিছনোর চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছিলেন ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে। এর পর দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বিএনপির প্রস্তাব এবং পরামর্শ উপেক্ষিত হলে, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে না-ও থাকতে পারে। চলতি বছরেই নির্বাচনের দাবিতে তারা মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবর।
আওয়ামী লাগের শীর্ষ সূত্র বলছে, বিএনপি মাঠে নামলে পিছন থেকে আওয়ামী লীগেরও মাঠে নামার পথ তৈরি হবে। শেষ পর্যন্ত চাপ বাড়লে যদি ইউনূস পদত্যাগে বাধ্য হন, তা হলে হয় দেশে সেনাশাসন হবে বা জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে। বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারও দায়িত্ব নিতে পারে। আওয়ামী লীগ আশাবাদী, সে ক্ষেত্রেও দলীয় কর্মীদের উপর যে দমনপীড়নের নীতি চলছে, তা বন্ধ হবে। দলের এক শীর্ষ নেতার মতে, গত এক মাসে প্রায় ৩ হাজার লীগ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)