আপনি কি এখন জীবিত?
প্রশ্ন শুনে মিন্টু পাসোয়ান হাসতে চেয়েও হাসতে পারেন না।
আপনি কি এ বার ভোট দেবেন?
মিন্টু পাসোয়ান উত্তর দেন, “অবশ্যই ভোট দেব।”
বিহারের ভোজপুর জেলার সদর আরা। পটনা থেকে সোন নদী পেরিয়ে প্রায় সত্তর কিলোমিটার রাস্তা। আরার বড়কি সিনাহি গ্রামে মিন্টু পাসোয়ানের বাড়ি। অল্প কিছু জমিজায়গা। তার সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে পেট চালাতে হয়।
বিহারে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) ইতিহাস বোধহয় মিন্টু পাসোয়ানকে বাদ দিয়ে লেখা যাবে না। নির্বাচন কমিশন এসআইআর প্রক্রিয়া শুরু করে প্রথমে খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছিল। তাতে বিহারের ৭.৯ কোটি ভোটারের তালিকা থেকে ৬৫ লক্ষ নাম বাদ যায়। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল, এর মধ্যে ২২ লক্ষ মৃত ভোটার। সেই ‘মৃত’ ভোটারের তালিকায় নাম ছিল ৪১ বছর বয়সি মিন্টু পাসোয়ানেরও। গত ১২ অগস্ট ‘মৃত’ মিন্টু পাসোয়ান সশরীরে হাজির হয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। এসআইআর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময়ে।
তারপর? মিন্টু বলেন, ‘‘নির্বাচন কমিশন আমাকে মৃত বলে দাগিয়ে দিয়ে ভোটার তালিকা থেকে নাম কেটে দেওয়ার সময় কোনও নথি দেখেনি। অথচ আমি ২০১৪, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, ২০১৫ ও ২০২০-র বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছি। আমি বেঁচে আছি প্রমাণ করতে ফর্ম পূরণ করতে হয়েছিল। সঙ্গে দিতে হয়েছিল আধার কার্ডের ফোটোকপি।” আধার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় বলে কমিশন বারবার সুপ্রিম কোর্টে দাবি করেছে। কিন্তু সেই আধার কার্ড ‘মৃত’ মিন্টুকে ‘জীবিত’ বলে প্রমাণ করেছে।
২২০ জন ভোটারকে বাদ দিতে বলে বিজেপি বিধায়কের চিঠি।
বিহারে এসআইআর শুরুর পর বিরোধীদের মহাগঠবন্ধন ‘ভোট চুরি’-র অভিযোগ তুলেছিল। রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব ভোটার অধিকার যাত্রা করেছিলেন। ‘ভোট চোর, গদ্দি ছোড়’-এর সেই স্লোগান এখন বিহারে নির্বাচনী ময়দানে শোনা যায় না। ভোট চুরির অভিযোগ কি তা হলে ভুল প্রমাণিত হল? মহাগঠবন্ধনের অন্যতম শরিক সিপিআই-এমএল লিবারেশনের আরার নেতা অভ্যুদয় বলেন, “বিজেপি যে ভোট চুরির চেষ্টা করেছে, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।” মিন্টু ও তাঁর মতো কয়েক জনকে লিবারেশনের নেতারাই আরা থেকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের দাবি, বিজেপি বেছে বেছে বিরোধী দলের সমর্থক ও কর্মীদের নাম বাদ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছিল।
কী রকম? বিহারে এসআইআর-এর খসড়া তালিকা প্রকাশের পর কারও নাম নিয়ে আপত্তি থাকলে তো বাদ দেওয়ার আর্জি জানানোর সুযোগ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কারও নাম ভুল করে বাদ গেলে তা যোগ করার দাবি জানানোর সুযোগও ছিল। মৃত বলে নাম বাদ যাওয়া মিন্টুর নাম আবার ভোটার তালিকায় যোগ হয়েছে। কিন্তু খসড়া তালিকা থেকে আরও ৩ লক্ষ ৬৬ হাজার নামবাদ গিয়েছে।
অভ্যুদয় বলেন, “আরার বিজেপি বিধায়ক অমরেন্দ্র প্রতাপ সিংহ নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখে বিধানসভা কেন্দ্রের ২২০ জনকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দিতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, দরকার হলে পাশের বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁদের নাম তোলা হোক। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ২২০ জনের সকলেই লিবারেশনের সমর্থক।” অভ্যুদয়ের অভিযোগ, খোদ বিধায়ক বেছে বেছে ভোটারদের নাম দিতে বলতে পারেন না। এত দিন ভোটাররা বিধায়ক বেছেছেন। বিজেপি জমানায় বিধায়ক ভোটারদের বেছে নিতে চাইছেন।
এখানেই শেষ নয়। এরপরে দেখা যায়, আরা-র একটি নির্দিষ্ট বুথ থেকে ৯৩ জনের নাম বাদ দেওয়ার আবেদন জমা পড়েছে। মণীশ কুমার নামে এক বিজেপি কর্মী একাই এত জনকে বাদ দেওয়ার আর্জি দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সকলেই লিবারেশনের কর্মী। বিরোধী নেতাদের সক্রিয়তায় ওই ২২০ জন ভোটার বা ৯৩ জন কর্মীর নাম বাদ যায়নি। তবে বিজেপি যে বেছে বেছে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, তা প্রমাণিত।
বিজেপি এসব অভিযোগ হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। অমরেন্দ্রর অনুগামীদের যুক্তি, একটা বিধানসভা কেন্দ্রে শ’দুয়েক ভোটারের নাম বাদ দিয়ে বর্তমান বিধায়কের কী লাভ হবে?
বিরোধী জোটের প্রধান শরিক আরজেডি নেতাদের দাবি, ভোজপুর, সাসারাম, রোহতাস, বক্সার জেলা মিলিয়ে বিহারের শাহবাদ অঞ্চলের ২২টি বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে। পাঁচ বছর আগে বিধানসভা নির্বাচনে এই ২২টি কেন্দ্রের মধ্যে মহাগঠবন্ধন ২০টি আসন জিতে নিয়েছিল। আরা-সহ মাত্র দুটি বিধানসভা কেন্দ্রে এনডিএ জিতেছিল। এর মধ্যে আরায় বিজেপির অমরেন্দ্র মাত্র তিন হাজার ভোটে লিবারেশনের প্রার্থী কইমুদ্দিন আনসারির বিরুদ্ধে জিতেছিলেন। এ বার মহাগঠবন্ধন ফের অমরেন্দ্রর বিরুদ্ধে কইমুদ্দিনকে প্রার্থী করেছে। তাই বিজেপি বিরোধী ভোটারদের নাম কাটতে চেয়েছে। বিহারের মানুষ ৬ ও ১১ নভেম্বরের ভোটে এরজবাব দেবেন।
‘মৃত’-র তালিকা থেকে ফের ‘জীবিত’ তালিকায় ফেরা মিন্টু পাসোয়ান ৬ নভেম্বর ভোট দিতে যাবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জীবিত ও মৃত’ গল্পে লিখেছিলেন, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।’
এসআইআর-এর ‘জীবিত ও মৃত’ চিত্রনাট্যে ভোট দিয়ে মিন্টু প্রমাণ করবেন, তিনি মরেন নাই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)