বিধায়কদের অনেকে গুয়াহাটি যান বিমানে চেপে। শাসকদলের হলে তো কথাই নেই। বিধানসভার অধিবেশন বা অন্য যে কোনও কাজে, আকাশপথেই যান তাঁরা। ব্যতিক্রম অজিত সিংহ। জেঠু জগন্নাথ সিংহের মৃত্যুর পর ১৯৯৮ সালের উপনির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে লাগাতার উধারবন্দের বিধায়ক। সব সময় গুয়াহাটি যান গাড়িতেই। প্রথমে পরিষদীয় সচিব, পরে মন্ত্রী হন। তাতে অভ্যাস বদলাননি। যেমন বদলায়নি প্রাতর্ভ্রমণ এবং সবার সঙ্গে কথা বলার অভ্যাস।
পরিষদীয় সচিবের দায়িত্বে থাকা পর্যন্ত একাই বেরিয়েছেন ভোরে। হাফ প্যান্ট, টি শার্ট। পায়ে স্যান্ডেল, কাঁধে অসমিয়া গামোছা। মন্ত্রী হওয়ার পর কোনও কোনও সময় এক জন সাদা পোশাকের রক্ষী পাশে থাকেন। হাঁটছেন আর যাকে দেখছেন গল্প করছেন। পরিচিতদের খবর নিচ্ছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন।
দর্শনার্থীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারটাও অভিনব। প্রাতর্ভ্রমণ সেরে বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে শুনে নেন সবার কথা। সেখানেই কারও কাগজে সই করছেন, কারও সমস্যার সমাধানে চা বাগানের ম্যানেজার বা অফিসারকে ফোন করছেন।
কিন্তু তিনি গাড়ি চড়ে যে পথে গুয়াহাটি যান, সেটি তাঁর নির্বাচনী এলাকা নয়। বরং বিমান ধরতে গেলে উধারবন্দ পেরিয়ে বিমানবন্দরে যেতে হতো। একই ভাবে প্রাতর্ভ্রমণে তিনি যে এলাকা ঘুরে বেড়ান, সেটি তাঁর আসন নয়। উধারবন্দের ভোটারদের বিধায়কের সঙ্গে দেখা করতে শিলচর ছুটতে হয়।
সেখান থেকেই বিজেপি-এআইইউডিএফ স্লোগান তুলেছে, বহিরাগত আর নয়। এ বার স্থানীয় প্রার্থীদের কাউকে ভোট দিন। এআইইউডিএফ প্রার্থী লিয়াকত হোসেনের বক্তব্য আরও স্পষ্ট, ‘‘আমাকে যাঁরা পছন্দ করেন, আমাকেই ভোট দেবেন। আমাকে যাঁরা পছন্দ করেন না, তাঁরাও অজিত সিংহকে ভোট দেবেন না। এর চেয়ে বরং বিজেপির মিহিরকান্তি সোম (ভানু)-কে দিন।’’
ভানুবাবুও সাদাসিধে কম নন। যে কোনও সমস্যায় মানুষের পাশে ছুটে যান। এর-ওর বিষয় নিয়ে দিনরাত ছোটাছুটি তাঁর। বহিরাগত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অনেক দিন থেকে লড়ছেন তিনি। প্রথমে দলের ভিতরে লড়াই করেন। গত নির্বাচনে একই আওয়াজ তুলেছিলেন। কিন্তু দল টিকিট দেয়নি। নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পান সাড়ে ১২ হাজার ভোট। দল সে বার প্রার্থী করে
সুরেন্দ্রপ্রসাদ সিংহকে।
এ বারও সুরেন্দ্রবাবু দাবিদার ছিলেন। ভানুবাবুর অনুগামীরা দলকে বোঝাতে সক্ষম হন, গত বারের প্রার্থীর সঙ্গে উধারবন্দের এখন আর কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি থাকেন শিলচরের মেহেরপুরে। ভানুবাবুর দাবি, দলের ভিতরের লড়াইটা যখন জিতে গিয়েছেন, ভোটের ময়দানে মানুষ তাঁকেই জেতাবেন।
বহিরাগত ছাড়াও অজিত সিংহের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, বাগান এলাকার বাইরে তিনি কোনও কাজ করেননি। কাশীপুরের তাজউদ্দিন বড়ভুঁইঞা, কুতুবউদ্দিন বড়ভুঁইঞা যে সুরে তাঁর সমালোচনা করলেন, সেই একই ঢঙে বললেন উত্তরপাড়ার বিজিত চক্রবর্তী, পানগ্রামের শিবু দাস। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী তাজউদ্দিন ও ব্যবসায়ী কুতুবউদ্দিন বলেন, ‘‘অজিত সিংহ কোনও কাজ করেননি। সরকারি অর্থ ব্যাপক লুটপাট করেছেন। সামান্য যে-টুকু কাজ হয়েছে, তা শুধুই চা বাগান অঞ্চলে। হিন্দু কি মুসলমান, বঙ্গভাষীদের কিছুই হয়নি।’’
বিজিত-শিবুর ক্ষোভ আরও তীব্র। তাঁদের অভিযোগ, ১৯৮৫ সালে এক বার শুধু জয়প্রকাশ তিওয়ারি এখানে জিতেছিলেন। ১৯৬৭ থেকে বরাবর উধারবন্দ আসনটি ইটখলার সিংহবাড়ির দখলে। প্রথমে জগন্নাথ সিংহ। তাঁর মৃত্যুর পর ভাইপো অজিত সিংহ বিধায়ক। হন মন্ত্রীও। জগন্নাথবাবুও দীর্ঘদিন মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু এলাকার উন্নতি হয়নি। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য পরিষেবা— সব দিক থেকে মানুষ যন্ত্রণায় ভুগছেন। সব সুবিধা লুটেছেন রামজনম চৌহান, পল্টু গোয়ালা, সম্পত রবিদাসের মতো কিছু লোক। তাঁদের সবার পরিবারে চাকরি হয়েছে। বাদ পড়েছেন বাঙালি যুবারা।
অজিতবাবু বাগান শ্রমিকদের জন্য খুব কাজ করেছেন, এরও কোনও ছাপ উধারবন্দের বাগানে টের পাওয়া যায়নি। বরাক উপত্যকার অন্যান্য বাগান থেকে এই অঞ্চলের শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় কোনও ফারাক
নেই। একে পুঁজি করে কয়েকটি বাগানে বিরোধীরা থাবা বসানোর চেষ্টায় রয়েছেন। রাজ্যের পরিবহণ, আবগারি, ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ মন্ত্রী অজিত সিংহের কথায়, ‘‘ও সব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই কয়েক বছরে যেমন বাগান অঞ্চলে প্রচুর কাজ হয়েছে, তেমনি বাগানের বাইরেও কাজ হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, কাঁচাকান্তি মন্দিরে ১ কোটি টাকা দিয়েছেন। উধারবন্দ বাজারে ৩০০ মিটার রাস্তা বানিয়েছেন। অজিতবাবু বলেন, ‘‘কত কাজের উল্লেখ করব! প্রকৃত নেতার কাছে জাতি-ধর্মে বাছবিচার থাকে না। আমিও করি না।’’ জয় নিয়ে ১০০ শতাংশ আশাবাদী অজিতবাবু। তিনি বললেন, ‘‘গত নির্বাচনে ৪৭ হাজার ভোটে জিতেছিলাম। এ বার লক্ষ্য, ব্যবধান বাড়ানোর।’’ সে সূত্রেই কংগ্রেসের যে কারও হিসেবে নিশ্চিত আসন হিসেবে ১ নম্বরে লেখা উধারবন্দে অজিত সিংহ। বিজেপি কর্মীরা বললেন, ‘‘এটা পুরোপুরি মিথ। এইবার তাঁদের একটাই লক্ষ্য, সেই মিথ ভাঙতে হবে।’’