Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
বিরোধীদের তোপের মুখে বন্দারু-স্মৃতি

দলিত হাওয়ায় বেসামাল বিজেপি

আড়াই মাসে পাঁচটি চিঠি! তার মধ্যে ২৫ দিনে চারটে! কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয়র কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে এমনটাই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল স্মৃতি ইরানির মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়কে বারবার তাগাদা দিয়ে জানতে চেয়েছিল, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

আত্মঘাতী দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন রাহুল গাঁধী। মঙ্গলবার হায়দরাবাদে। ছবি: পিটিআই।

আত্মঘাতী দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন রাহুল গাঁধী। মঙ্গলবার হায়দরাবাদে। ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৭
Share: Save:

আড়াই মাসে পাঁচটি চিঠি! তার মধ্যে ২৫ দিনে চারটে!

কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয়র কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে এমনটাই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল স্মৃতি ইরানির মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়কে বারবার তাগাদা দিয়ে জানতে চেয়েছিল, অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই ‘চাপের’ মুখেই দলিত ছাত্র রোহিত ভেমুলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নির্দেশ জারি হয়েছিল, ক্লাসরুম ও গবেষণাগার ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনও সুবিধা, যেমন ক্যান্টিন বা হস্টেল ব্যবহার করতে পারবেন না তিনি। এই নির্দেশের জেরেই গত রবিবার রোহিত আত্মহত্যা করেছেন বলে তাঁর পরিবারের দাবি।

ভেমুলার আত্মহত্যা এবং আত্মহত্যার আগে তাঁর লেখা চিঠি ঘিরে এখন উত্তাল হায়দরাবাদ থেকে দিল্লি। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আরও এক বার উঠে এসেছে দলিত রাজনীতি। এবং আক্রমণের নিশানায় ফের বিজেপি।

দলের পালে সেই রাজনীতির হাওয়া টানতে আজ সকালেই হায়দরাবাদ উড়ে যান কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। রোহিতের পরিবার ও হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে তোপ দাগেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি ও বন্দারু দত্তাত্রেয়র ভূমিকা নিয়ে। আসরে নেমেছে অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টি থেকে তৃণমূল— সকলেই। বিজেপি বুঝতে পারছে, এই সমবেত আক্রমণ থেকে বেরনোর একমাত্র পথ প্রতিআক্রমণ। কিন্তু তাদের সমস্যা হল, কাকে ছেড়ে কাকে নিশানা করবে তারা! রাহুল যখন হায়দরাবাদে, তখন আপ ছাত্র নেতারা যন্তরমন্তরে ওই মৃত্যুর প্রতিবাদে দিনভর বিক্ষোভ দেখান। দেশব্যাপী বিক্ষোভ দেখিয়েছে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনও। সকাল থেকে অনশনে বসেছেন পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পড়ুয়ারা। রাতেই হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন ও প্রতিমা মণ্ডল। আর দলিত রাজনীতি যাঁর মূলধন, সেই মায়াবতীও হায়দরাবাদ যেতে পারেন বলে জানিয়েছেন বিএসপি নেতারা। এমনকী, এই ক’দিন আগেও বিহার ভোটে যিনি বিজেপির পাশে ছিলেন, সেই এমআইএম সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়াইসিও ছাত্রদের মাঝে দাঁড়িয়ে এই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করেছেন।

শুরু হয়েছে পদক ফেরানোর পালাও। বিজেপির বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা প্রশ্নটিই ফের তুলেছে নাগরিক সমাজ। এই প্রশ্ন তুলেই হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ডিলিট ফেরানোর কথা জানিয়েছেন কবি অশোক বাজপেয়ী। বিজেপি যখন রোহিত ও তাঁর সঙ্গীদের মুম্বই বিস্ফোরণের মাথা ইয়াকুব মেমনের সমর্থনকারী হিসেবে তুলে ধরতে মরিয়া, তখন নতুন করে এই খেতাব ফেরানোর পালা শুরু হওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন। বিজেপির মূল দুশ্চিন্তা হল, প্রতিটি রাজ্য নির্বাচনের আগে এ ভাবে অসহিষ্ণুতার বিষয়টি উঠে আসা নিয়ে। তারা বলছে, একই ছবি দেখা গিয়েছিল বিহার নির্বাচনের আগে। নির্বাচনের পরেই বিষয়টি থিতিয়ে যায়! সামনে আবার একাধিক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপির আশঙ্কা, যত নির্বাচন এগিয়ে আসবে, তত এই প্রবণতা বাড়বে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে রাহুলকে ‘নন-সিরিয়স, পার্ট টাইম’ রাজনীতিক বলে কটাক্ষ করে বিজেপি সচিব শ্রীকান্ত শর্মা এ দিন বলেন, ‘‘যেখানেই দলিতের উপর কোনও আক্রমণ হয়, প্রথমেই বিজেপির গায়ে তকমা সেঁটে দেওয়া হয়!’’ একই সঙ্গে তাঁর দাবি, আত্মঘাতী ছাত্রকে সেখানকার প্রশাসন হস্টেল ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মাত্র। তার পিছনে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির কোনও সম্পর্ক নেই।

কিন্তু শ্রীকান্ত যা-ই বলুন, রোহিতের আত্মহত্যার ঘটনায় বন্দারু দত্তাত্রেয়র নামে পুলিশে অভিযোগ দায়ের হওয়ায় বেশ ব্যাকফুটে দল। দত্তাত্রেয় ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আপ্পা রাও, বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র দুই নেতা ও বিজেপির বিধান পরিষদের নেতা রামচন্দ্র রাওয়ের শাস্তির দাবিতে সরব ছাত্ররা। আজ স্মৃতি ইরানির ইস্তফাও দাবি করেছেন রাহুল। কংগ্রেসের যুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক যে ভাবে অতিসক্রিয়তা দেখিয়েছে, তার দায় স্মৃতি এড়াতে পারেন না। বিজেপি অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, স্মৃতি বা বন্দারু— কারওরই ইস্তফা দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না।

কিন্তু বন্দারুর ভূমিকা নিয়ে যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সে কথা একান্তে মেনে নিচ্ছেন বিজেপির অনেক শীর্ষ নেতাই। রোহিতদের ‘চরমপন্থী’, ‘অপরাধী’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা নিয়ে স্মৃতি ইরানির কাছে তদ্বির করেছিলেন বন্দারু। সে চিঠি সংবাদমাধ্যমের কাছে আছে। সহপাঠীদের অভিযোগ, ওই চিঠির পরেই নতুন করে সাসপেন্ড করা হয় রোহিতদের। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, বন্দারু কেন এ ভাবে অতিসক্রিয় হলেন?

প্রকাশ্যে বন্দারুর পক্ষ নিয়ে বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহের যুক্তি, ‘‘স্মৃতি ইরানিকে লেখা বন্দারু দত্তাত্রেয়র চিঠি আর ছাত্রের আত্মহত্যার কোনও যোগসূত্র নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছিল। তাতে পোস্টারে লেখা ছিল, ‘কিতনা ইয়াকুব কো মারোগে, হর ঘর সে ইয়াকুব নিকলেঙ্গে’ (কত ইয়াকুবকে মারা হবে, প্রতি ঘর থেকে ইয়াকুব বেরোবে)। বিক্ষোভরত ছাত্ররা বিজেপির ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মারধর করে।’’ যদিও ঘটনা হল, চিকিৎসকদের রিপোর্টে কোনও চোট-আঘাতের চিহ্ন না থাকায় রোহিতদের উপর থেকে প্রথমে সাসপেনশন তুলে নেওয়া হয়। তখন বিজেপির ছাত্র সংগঠনের নেতারা স্থানীয় সাংসদ বন্দারুর দ্বারস্থ হন। বন্দারু দলের ছাত্রনেতাদের সেই চিঠিটি স্মৃতি ইরানির কাছে পাঠিয়ে দেন। সিদ্ধার্থর ব্যাখ্যা, স্মৃতির মন্ত্রক সেই অভিযোগ পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ঘটনাটি জানতে চান মাত্র। বিজেপি নেতাদের মতে, অভিযোগ এলে সেটির বিষয়ে জানতে চাওয়া স্বাভাবিক নিয়ম। অভিযোগ পাওয়ার পর মন্ত্রক কোনও পদক্ষেপ না করলে তো উল্টো সমালোচনা হতো!

এখানেও প্রশ্ন রয়েছে। যা তুলেছেন খোদ মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কর্তারাই। তাঁদের মতে, সাংসদদের এ ধরনের চিঠি মন্ত্রকের কাছে ফি দিনই আসে। কংগ্রেস আমলে দলের নেতা-মন্ত্রীরা এ ধরনের চিঠি পাঠানোর বিশেষ বালাই রাখতেন না। তাঁরা বেশির ভাগ ফোনেই কাজ সারতেন! আর এখানে বন্দারুর ওই চিঠির ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনও পদক্ষেপ করেছেন কিনা, তা জানতে চেয়ে পাঁচ-পাঁচটি চিঠি পাঠিয়েছিল মন্ত্রক। সেটাই চাপে ফেলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

national news bjp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE