Advertisement
E-Paper

দুপুর গড়ালেও খালি হাতে বসে কার্তিক-শত্রুঘ্নরা

মন্দার ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে দেশের গাড়ি শিল্পে। বিক্রি কমছে, ফলে উৎপাদনও। কাজ হারাচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। মন্দার ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে দেশের গাড়ি শিল্পে। বিক্রি কমছে, ফলে উৎপাদনও। কাজ হারাচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক।

দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৯ ০৪:৫০
কিছু যন্ত্র বন্ধ। আংশিক কাজ চলছে আদিত্যপুর শিল্পাঞ্চলে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায়। ছবি: পার্থ চক্রবর্তী

কিছু যন্ত্র বন্ধ। আংশিক কাজ চলছে আদিত্যপুর শিল্পাঞ্চলে গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায়। ছবি: পার্থ চক্রবর্তী

মাঝদুপুর। জামশেদপুর সংলগ্ন আদিত্যপুর শিল্পাঞ্চলের ‘বিকো’ মোড়। একটি ছোট দোকানের সামনে বসে শত্রুঘ্ন রজক, কার্তিক শর্মা, প্রকাশ তাঁতি-সহ বেশ কয়েক জন। কাজের অপেক্ষায়। কয়েক মাস আগেও গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির ছোট ছোট কারখানায় পণ্য খালাসের কাজ করে দিনে পাঁচ-সাতশো টাকা রোজগার হত। এখন প্রায় দিনই চুপচাপ বসে থাকা। শিল্পাঞ্চলের বেশির ভাগ কারখানাতেই উৎপাদন ছাঁটাই চলছে। তাই কাঁচামাল আনা বা তৈরি জিনিস জোগানের দরকারও কমেছে।

মোড় পেরিয়ে একটু ভিতরে গাড়ির চেসিসের একটা অংশ তৈরির কারখানায় কাজ করেন মাইকেল চামার। সপ্তাহখানেক আগেও কারখানা বন্ধ ছিল। ফের নাকি বন্ধ হতে পারে। কারখানা বন্ধ হলে বাধ্যতামূলক ছুটি নিতে হয়। ছুটি ফুরোলে বেতনে কোপ।

অন্য কারখানার মতো আগে তিন শিফটেই কাজ হত শিশির মাহাতো, মধুসূদন মাহাতোদের গাড়ির স্টিয়ারিং, রবারের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানাতেও। এখন শুধুই একটি শিফট— সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা।

এমনই আর এক যন্ত্রাংশ কারখানার শ্রমিক বুধিরাম মাহাতোকে পাওয়া গেল স্থানীয় চায়ের দোকানে। আগে কারখানায় ক্রেন চালাতেন। সেই কাজ খুইয়ে কিছু দিন অন্য ঠিকাদারের অধীনে কাজ করলেও এখন বেকার।

জামশেদপুর থেকে প্রায় ৯ কিমি দূরে আদিত্যপুর শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ ছোট সংস্থাই গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি করে। বড় অংশ জামশেদপুরের টাটা মোটরসের কারখানার উপর নির্ভরশীল। কিছু সংস্থা অবশ্য ভিন্ রাজ্যেও যন্ত্রাংশের জোগান দেয়।

আদিত্যপুর শিল্পাঞ্চল

• প্রায় ১৫০০টি ছোট ও মাঝারি কারখানা
• অধিকাংশই গাড়ি যন্ত্রাংশ তৈরি করে
• বাকিরা কাস্টিং, প্লাস্টিক, রেলের যন্ত্রাংশ, কাচ ইত্যাদি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত
• প্রায় দেড় লক্ষ কর্মী
• তার মধ্যে প্রায় এক লক্ষ কারখানা নিযুক্ত অস্থায়ী ও ঠিকাদার নিযুক্ত কর্মী
• বরাতের অভাবে বহু কারখানা মাঝে মধ্যে বন্ধ থাকছে

যন্ত্রাংশ শিল্পের মতে

• বাজারে সার্বিক ভাবেই গাড়ির চাহিদা কম
• আবাসন ও রাস্তার মতো নির্মাণ শিল্প, খনি-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের কাজও থমকে
• ফলে বাণিজ্যিক গাড়ির চাহিদা তলানিতে
• গোটা দেশে প্রায় ১০ লক্ষ কাজ ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা

দেশ জুড়ে গাড়ি শিল্পে আকাল। রেহাই পায়নি জামশেদপুরও। এখানে টাটা মোটরসের কারখানায় ভারী ও মাঝারি ধরনের বাণিজ্যিক গাড়ি তৈরি হয়। পূর্ব ভারতের প্রথম বাণিজ্যিক গাড়ির কারখানা এটি। সোসাইটি অব ইন্ডিয়ান অটোমোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্সের হিসেবে, আগের বছরের চেয়ে এ বার এপ্রিল-জুনে দেশে বাণিজ্যিক গাড়ির বিক্রি কমেছে ২৫ হাজারেরও বেশি (২১.৬%)। উৎপাদন কমেছে ৩০ হাজারেরও বেশি (২২.৩%)। টাটা মোটরস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট গুরমিত সিং জানান, মাস তিনেক আগে কারখানায় মাসে হাজার দশেক বাণিজ্যিক গাড়ি তৈরি হলেও এখন মেরে কেটে হচ্ছে সাড়ে তিন-চার হাজার। আগামী মাসে তা বাড়বে, এমন ইঙ্গিত এখনও মেলেনি। বরং ফের গত শনিবার চতুর্থ দফায় কারখানা বন্ধ রেখেছিল সংস্থাটি।

মূল সংস্থায় উৎপাদন ছাঁটাইয়ের জেরে বরাত কমছে আদিত্যপুর শিল্পাঞ্চলের কারখানাগুলির। তাই তারাও মাঝে মধ্যেই কাজ বন্ধ রাখছে। আদিত্যপুর শিল্পাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা ঝাড়খণ্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া ডেভেলপমেন্ট অথরিটির কর্তারা জানাচ্ছেন, ৩০-৪০% অস্থায়ী ও ঠিকা কর্মীর হয় কাজ গিয়েছে, নয়তো সাময়িক বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী কর্মীদের ছুটি নিতে বলা হচ্ছে।

সিংভূম ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি তথা আদিত্যপুরেরই যন্ত্রাংশ শিল্পের প্রবীণ উদ্যোগপতি বিকাশ মুখোপাধ্যায়ের কারখানাতেও উৎপাদন অনিয়মিত। তিনি জানালেন, আগে আদিত্যপুরে তাঁর সংস্থার পাঁচটি ইউনিট থেকে দিনে ৯০টি ট্রাক যন্ত্রাংশ নিয়ে যেত। এখন আসে বড়জোর ১৫-২০টি। কাজ হচ্ছেএকটিই শিফটে। তাঁর ও কর্মীদের অনেকেরই দাবি, ২০০৮-০৯ সালের মন্দার সময়েও এমন অবস্থা হয়নি।

যদিও গুরমিতদের দাবি, টাটার কারখানা সাময়িক বন্ধের অন্যতম কারণ অস্থায়ী কর্মীদের কাজের সুযোগ বাড়ানো। কারখানায় উৎপাদন কম হলে স্থায়ী কর্মীরাই সেই কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু দু’এক দিন কারখানা বন্ধ থাকলে পরে উৎপাদন বাড়াতে হয়। তখন বাড়তি কর্মীর দরকার পড়ে।

ভবিষ্যতে ফের কারখানা বন্ধ রাখার সম্ভাবনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চায়নি টাটা মোটরস। অবশ্য সংস্থার আশা, কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের জেরে গাড়ি শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে। যদিও বিকাশবাবু কিছুটা সন্দিহান, ওই ঘোষণায় আদৌ কবে চাকা ঘুরবে, তা নিয়ে। তাঁর প্রশ্ন, সুদের হার কতটা কমবে? সরকারের গাড়ি কেনার ভাবনায় বাজারের চাহিদারই বা কতটুকু পূরণ হবে? নতুন নির্মাণকাজ থমকে থাকায় বাণিজ্যিক গাড়ির চাহিদা কতটা বাড়বে?

অনিশ্চয়তার মধ্যেই আপাতত দিন গুজরান করছে আদিত্যপুর শিল্পতালুক। সেখানে এখন সাইরেনের চেনা শব্দ কম। বরং বাতাসে যেন কানাকানি, ‘কাল কি আবার কাজ বন্ধ? এ বার ক্লোজার কোন কারখানায়?’

auto industry
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy