Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পর্যটন মানচিত্রে উপেক্ষিত বরাক, ক্ষুব্ধ উপত্যকা

অনেকে দাবি করেন, চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে শিলচরের কথা উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস বলে, সপ্তম শতকে ভাস্করবর্মার আমলে তিনি কামরূপ এসেছিলেন। কাছাকাছি কয়েকটি সমৃদ্ধ অঞ্চলের নাম তাঁর সি-ইউ-ই বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে শ্বিলিচটল। চৈনিকদের উচ্চারণে ‘ট’-এর ব্যবহার নেই। তাই সেটি চৈনিক উচ্চারণে শ্বিলিচল। কারও কারও মতে, এটি সিলেট।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত ও উত্তম সাহা
গুয়াহাটি ও শিলচর শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

অনেকে দাবি করেন, চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে শিলচরের কথা উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস বলে, সপ্তম শতকে ভাস্করবর্মার আমলে তিনি কামরূপ এসেছিলেন। কাছাকাছি কয়েকটি সমৃদ্ধ অঞ্চলের নাম তাঁর সি-ইউ-ই বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে শ্বিলিচটল। চৈনিকদের উচ্চারণে ‘ট’-এর ব্যবহার নেই। তাই সেটি চৈনিক উচ্চারণে শ্বিলিচল। কারও কারও মতে, এটি সিলেট।

দক্ষিণ অসমের মানুষের দাবি সেটি শিলচর। তাঁদের আক্ষেপ, সেই কোন কালে হিউয়েন সাঙ শিলচরের দিকে বহির্বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেও, এখনও পর্যন্ত অসম সরকারের পর্যটন মানচিত্রে এই অঞ্চলের উল্লেখ নেই। পর্যটকদের জন্য অসমের যে সব জায়গার কথা প্রচার করা হয়, তাতে শিলচর-সহ বরাক উপত্যকা উপেক্ষিত। অথচ প্রাসাদোপম দালানবাড়ি বা আধুনিক বিনোদনের কথা বাদ দিলে, পর্যটকরা যে সব কারণে কোনও জায়গার প্রতি আকৃষ্ট হন, বরাক উপত্যকায় তার সবই বর্তমান। যে দু’য়েকটি জায়গায় পর্যটন দফতর টাকা খরচ করেছে বলে দাবি করা হয়, তা-ও পরিকল্পনার অভাবে ধুঁকছে।

অসম পর্যটন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মানিকচন্দ্র শর্মা অবশ্য এ কথা মানতে চাননি। তিনি জানিয়েছেন, বরাকে পর্যটন উন্নয়নের জন্য ২০০৫-০৬, ২০০৭-০৮ ও ২০১০-১১ সালে পর্যটন দফতর কয়েকটি প্রকল্প তৈরি করেছিল। তাঁর দাবি, পুরনো প্রকল্পগুলির কাজ শেষ হয়েছে বা হওয়ার মুখে।

তিনি জানান, সেগুলির মধ্যে রয়েছে, শিলচর গাঁধীবাগে পর্যটন পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও উদ্যান, করিমগঞ্জে ট্যুরিস্ট লজ ও অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের উন্নয়ন, শিলচরের ভুবন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়ার শিব মন্দির পর্যন্ত রাস্তা, খাসপুর প্রত্নস্থল পর্যন্ত রাস্তার উন্নয়ন, নর্মাল স্কুলের পাশে শিশু উদ্যান। উদারবন্দ কাছাকান্দি মন্দিরে পর্যটন পরিকাঠামোর বিকাশ, রানিধি পুকুরে জেটি, বরাক নদীর তীর সাজানো, সুতারকান্দিতে রাস্তা, শিলচর ট্যুরিস্ট লজের উন্নয়নের কাজও করা হয়েছে।

পর্যটন দফতর সূত্রে খবর, নামনি হাফলঙ থেকে আপার হাফলঙ পর্যন্ত রাস্তায় আলো বসানো হচ্ছে, ওই শহরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে তৈরির কাজ জোরকদমে চলছে। সোনটিলায় তৈরি হচ্ছে হেলিপোর্ট। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, কুমারপাড়া মহাপ্রভু আশ্রম, কাছাকান্দি মন্দির, বড়খোলা, সোনাই ইসলামিক মাদ্রাসা, চন্দ্রনাথপুর কালীমন্দির, ঢোলছেঁড়াকান্দ্রা মন্দিরে ‘কমিউনিটি হল’ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালে কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ জেলায় পর্যটন পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় পর্যটন মন্ত্রকের কাছে ৮ কোটি টাকা অর্থসাহায্যের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। রাজ্যের পর্যটন দফতরের আশা, ব্রডগেজ রেল লাইনে ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ার পর বরাকে পযর্টকদের সংখ্যা বাড়বে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই অঞ্চলে ছোট-বড় ১১০টি বাগান রয়েছে। চা বিশ্বজনীন পানীয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানেন না, চা কী করে উৎপাদিত হয়। সে জন্য চা-উৎসব করে তার পুরো প্রক্রিয়া দেখানো যেতে পারে। সঙ্গে চা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তুলে ধরলে, পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়বে। পশ্চিম জালেঙ্গার মত কয়েকটি চা বাগান রয়েছে, যেখানে রাসায়নিক সার-কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। সঠিক ভাবে প্রচার করা হলে, এই জৈব বাগানও পর্যটক টানতে পারে।

প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন হিসেবে রয়েছে ভুবন পাহাড়, খাসপুরে ডিমাসা রাজবাড়ি। ভুবন পাহাড়ের নাম শৈলেশ্বর। দীনবন্ধু মিত্রের নাটকে এটির উল্লেখ রয়েছে। প্রচুর পাথরের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে ওই পাহাড়চূড়ায়। আছে একটি রহস্যময় গুহা। ঘন অন্ধকার ও জল চুঁইয়ে পড়ে বলে তার ভেতরে কেউ ঢুকতে পারেন না। খাসপুরের রাজবাড়ির ইতিহাসও আকর্ষণীয়। বড়খলায় ডিমাসা রাজাদের নৃমাতা মন্দির, রণচণ্ডী মন্দির রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বদরপুর দুর্গ, বুন্দাশীলে পর্তুগিজ নিবাস, সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিজড়িত মালেগড় ও রণটিলা, হাইলাকান্দি লালার শকালা দীঘির কথা সঠিক ভাবে তুলে ধরা গেলে পর্যটকরা আকৃষ্ট হবেন। ধর্মকর্মের জন্য যারা ঘুরে বেড়ান, তাঁদের জন্য এখানে রয়েছে সিদ্ধেশ্বর কপিলাশ্রম, পাঁচগ্রামের শাহ মিরাফিং মোকাম, চরকিশাহ মোকাম, কাঁচাকান্তি কালীমন্দির, সোনাইয়ের চন্দ্রগিরি শিবমন্দির, বুন্দাশীল গির্জা ইত্যাদি। ডিমাসা, বাঙালি ও মণিপুরিদের তীর্থস্থান চন্দ্রগিরি।

প্রকৃতি পর্যটনেরও অনেক সুযোগ রয়েছে উপত্যকায়। শনবিল নামে সুদীর্ঘ হ্রদ, রামনগর ও বাঁশকান্দিতে নদীর ফেলে যাওয়া অংশ (স্থানীয় নাম আনুয়া), বরাক নদীতে নৌকাবিহার, চাতলা হাওর, বড়াইল অভয়ারণ্য, ছাতাচূড়া ও প্রতাপগড় বনাঞ্চল, জৈব বৈচিত্র্য। কাছাড় জেলার নারায়ণডহরকে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম নদীদ্বীপ বলে দাবি এখানকার মানুষের। সেখানে একটি শিবমন্দিরও রয়েছে।

পর্য়টন দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘বরাকে চা পর্যটনের প্রস্তাব আসেনি। খাসপুর-সহ কয়েকটি প্রত্নস্থল আর্কিওলজিক্যাল অব ইন্ডিয়ার অধীন। তবে যখনই বরাক নিয়ে কোনও প্রস্তাব এসেছে, তা পূরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।’’ উপত্যকার বাসিন্দারা জানান, রামনগর আনোয়ায় একটি বাতানুকূল নৌকা রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রচারের অভাবে কেউ কোনও দিনই সেখানে যায়নি। পরে যন্ত্রটি খুলে নেওয়া হয়। নৌকাটিও অন্য কাজে লাগানো হয়। ভুবন পাহাড়ে ওঠার সিঁড়িও অর্ধনির্মিত রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE