Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

হাটখোলা হবে সম্পত্তি, ফাঁপরে কেন্দ্রীয় কর্মীরা

দেরাজে স্ত্রীর ক’ভরি গয়না রয়েছে, ব্যাঙ্কে লকারে কত সবই যদি সহকর্মী, আত্মীয়-কুটুম, মায় পাড়াপড়শিও জেনে যায়, সেটা কেমন হবে! দেশশুদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরে ও তাঁদের পরিবারের লোকজন পড়েছেন বেজায় অস্বস্তিতে। লোকপাল ও লোকায়ুক্ত আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী সরকারি চাকুরেদের নিজের এবং স্ত্রী বা স্বামীর ও আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল সন্তানের সমস্ত সম্পত্তির সবিস্তার হিসেব দিতে হবে সরকারকে।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫০
Share: Save:

দেরাজে স্ত্রীর ক’ভরি গয়না রয়েছে, ব্যাঙ্কে লকারে কত সবই যদি সহকর্মী, আত্মীয়-কুটুম, মায় পাড়াপড়শিও জেনে যায়, সেটা কেমন হবে! দেশশুদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরে ও তাঁদের পরিবারের লোকজন পড়েছেন বেজায় অস্বস্তিতে।

লোকপাল ও লোকায়ুক্ত আইনের ৪৪ ধারা অনুযায়ী সরকারি চাকুরেদের নিজের এবং স্ত্রী বা স্বামীর ও আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল সন্তানের সমস্ত সম্পত্তির সবিস্তার হিসেব দিতে হবে সরকারকে। শুধু কি তা-ই? লোকপাল কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে সেই বার্ষিক বিবৃতি হুবহু তুলে দেওয়ার কথা। ফলে দুনিয়ার যে কেউই ওই ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখে নিতে পারবেন প্রত্যেক সরকারি কর্মী ও তাঁর পরিবারের জমি-জমা-সম্পত্তির তত্ত্ব-তালাশ!

প্রশ্ন উঠেছে, দেশের আর সবার জন্য অন্য ব্যবস্থা, আর কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরেদেরই শুধু ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে কিছু থাকবে না! সরকারি কর্মীর স্ত্রী বা স্বামী হওয়াটাও কি অপরাধ! কিন্তু যেহেতু এটা মোদী সরকারের কোনও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং লোকপাল আইন অনুযায়ী সরকার এই নিয়ম বলবত্‌ করতে বাধ্য, তাই কর্মীদের তরফে এ নিয়ে কোনও আন্দোলন শুরু হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে আপত্তি তুলে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন বিনীতা সিংলা নামে এক আমলার স্ত্রী। সেই মামলায় দিল্লি হাইকোর্ট কাল বলেছে, সম্পত্তির হিসেব এখনই যেন ওয়েবসাইটে না দেওয়া হয়। হিসেব আপাতত মুখবন্ধ খামে রাখতে হবে। কিন্তু এতে অস্বস্তি বা আশঙ্কা বিশেষ লঘু হয়নি কেন্দ্রীয় সরকারি সব অফিসের অলিন্দে। কারণ এটা অন্তর্বর্তী রায় মাত্র।

কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী মহলে আশঙ্কা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বজায় রাখতে যে রকম কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন, তাতে হয়তো এ ক্ষেত্রেও অনমনীয় অবস্থান নেবে তাঁর সরকার। তাই কেন্দ্রীয় কর্মিবর্গ মন্ত্রক আদালতে এ ব্যাপারে কী ব্যাখ্যা দেয় তার অপেক্ষায় রয়েছেন কর্মীরা।

শেষ পর্যন্ত ওয়েবসাইটে সম্পত্তির খতিয়ান থাকবে কি না, সে প্রশ্ন তো থাকছেই, হ্যাপা অনেক বেড়ে গিয়েছে হিসেবনিকেশ দেওয়া নিয়েও। আগে একটি এক পাতার ফর্ম ভরে দফতরে জমা দিলেই চলত। তাতে স্ত্রী/স্বামী ও সন্তানের আয় ও সম্পত্তির হিসেব নিয়ে কোনও জটিলতা ছিল না। তা-ও সব দফতরে তা বাধ্যতামূলকও ছিল না। কিন্তু এখন আট পাতার ফর্ম ধরানো হয়েছে। গোড়ায় বলা হয়েছিল, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দিতে হবে। এখন মেয়াদ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

কী কী তথ্য চাওয়া হয়েছে?

নিজের, স্ত্রী/স্বামী ও নির্ভরশীল সন্তানের নামে ব্যাঙ্কে যা যা জমা রয়েছে তার হিসেব।

বন্ড বা ডিবেঞ্চার কিছু কেনা থাকলে কিংবা বিমা, এনএসএস সার্টিফিকেট বা ডাকঘরে কোনও সঞ্চয় থাকলে তার হিসেব।

কাউকে ঋণ দিলে বা ঋণ নিয়ে থাকলে তা-ও। কার কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে, কী শর্তে।

নিজের, স্ত্রী/স্বামী, নির্ভরশীল সন্তানের নামে বাড়ি বা জমি থাকলে তা কবে, কী ভাবে কেনা হয়েছে, ঠিকানা কী, জমির চরিত্র কী, সেই সম্পত্তি থেকে বার্ষিক আয়।

নিজের, স্ত্রী/স্বামী, নির্ভরশীল সন্তানের কাছে কতটা কী সোনা-রুপোর গয়না ও মূল্যবান রত্ন রয়েছে, ও সে সবের বাজার মূল্য।

সরকারি কর্মীর কাছে কোনও মোটরগাড়ি থাকলে তা জানাতে হবে। কারও কাছে বিমান বা জাহাজ থাকলে তার মূল্য ও কোন কোম্পানির তৈরি।

লোকায়ুক্ত আইনের আওতায় এই বিজ্ঞপ্তি নিয়েই এখন হইচই পড়ে গিয়েছে সব কেন্দ্রীয় সরকারি দফতরে। কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের এক আমলা বলেন, সম্পত্তির হিসেব দিতে কোনও অসুবিধা হয়নি। তা সরকার যে কোনও সময় চাইলে খতিয়ে দেখতেই পারে। কিন্তু সেই তথ্য ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে কেন? এই নিয়ে যিনি মামলা করেছেন, সেই বিনীতা সিংলার বক্তব্য, এতে তাঁর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এক জন সরকারি কর্মীর স্ত্রী হওয়াটা কি অপরাধ? তা ছাড়া সব সময়ই যে কোনও সরকারি কর্মচারীর আয় থেকেই তাঁর পরিবারের সদস্যরা সম্পত্তি কিনবেন এমন না-ও হতে পারে। পারিবারিক সূত্রেও কোনও সম্পত্তি কেউ পেতে পারেন। সেই তথ্য কেন ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে?

হাইকোর্ট তার অন্তর্বর্তী রায়ে, সম্পত্তির হিসেব ওয়েবসাইটে দেওয়া স্থগিত রাখলেও, চূড়ান্ত রায় কী হবে তা নিয়ে অস্বস্তি যাচ্ছে না সরকারি কর্মীদের। এমন দিনও কি আসবে, যখন ওয়েবসাইটে সম্পত্তির খতিয়ান দেখে নিয়েই এগোবে বিয়ের সম্বন্ধ! শ্বশুরের কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তির হিসেব, লকারে লুকোনো বৌয়ের সাতনরি হার বা হিরের নাকছাবি নিয়ে চোখ টাটাবে সহকর্মী! পাড়ার পুজোয় চাঁদাও ঠিক এর ভিত্তিতে! পড়শিদের মধ্যে প্রকাশ্যেই চলবে এ সবের চর্চা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE