টিপটিপ করে দিনভর বৃষ্টি। বিকেলের গান্ধী ময়দান কার্যত ফাঁকা। একা গান্ধীমূর্তি ভিজে চলেছে।
কলকাতায় ব্রিগেড ময়দান বাংলার রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী থাকে। বিহারের রাজনীতির উত্থানপতনের তেমনই সাক্ষী পটনার গান্ধী ময়দান।
দু’মাস আগে এই গান্ধী ময়দানেই রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব গান্ধীমূর্তিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ শেষ করেছিলেন। বিহারে তখন নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর-এর কাজ চলছে। বিজেপি-নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ‘ভোট চুরি’-র অভিযোগ তুলে ১৬ দিন ধরে সাসারাম থেকে পটনা পর্যন্ত রাহুল-তেজস্বী ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ করেছিলেন। স্লোগান ছিল ‘ভোট চোর, গদ্দি ছোড়’। গত ১ সেপ্টেম্বর পটনায় শেষ হয়েছিল রাহুল-তেজস্বীর যাত্রা।
তার পরে দু’মাস কেটে গিয়েছে। গান্ধী ময়দানের আশেপাশে চায়ের আড্ডায় ‘ভোট চুরি’ বা ‘এসআইআর’ বৃষ্টিতে ভেজা ভুজিয়ার মতো মিইয়ে গিয়েছে। এখন ঢের বেশি মুখরোচক বিষয় হল— এনডিএ জিতলে বিজেপি কেন নীতীশ কুমারকেই শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হবে? প্রশান্ত কিশোর কার যাত্রাভঙ্গ করবেন? তেজস্বী যাদব কি যাদবদের সঙ্গে ইবিসি ভোটও পাবেন? পটনার বীরচাঁদ পটেল রোডেই বিজেপি ও জেডিইউ-র দফতর। এনডিএ-র দুই প্রধান দলের নেতাদেরই দাবি, বিরোধীদের এসআইআর অস্ত্রে মরচে পড়ে গিয়েছে। ও দিয়ে আর এনডিএ-র ভোট কাটা যাবে না।
সেই কারণেই হয়তো, দু’মাস আগে যে এসআইআর-এর বিরুদ্ধে তাঁরা পথে নেমেছিলেন, বুধবার সেই এসআইআর প্রসঙ্গই রাহুল গান্ধী ও তেজস্বী যাদবের মুখে বিশেষ শোনা গেল না। এ দিন একসঙ্গে জোড়া জনসভা করেন তাঁরা। তবে সেই সভায় ‘ভোট চুরি’ নিয়ে আশঙ্কার সুর দু’জনের গলাতেই শোনা গেল।
ভোটার অধিকার যাত্রা-র পরে এই প্রথম রাহুল বিহারে প্রচারে এলেন। বিরোধীদের মহাগঠবন্ধনের আসন বণ্টন নিয়ে বিবাদ পিছনে ফেলে এই প্রথম রাহুল ও তেজস্বী প্রথম জনসভা করলেন। প্রথমে মুজফ্ফরপুরের সকরা বিধানসভা কেন্দ্রে, কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে। তার পরে দ্বারভাঙায়, আরজেডি প্রার্থীর হয়ে।
৬ নভেম্বর বিহারের প্রথম দফার ভোটগ্রহণের আগে দুই জনসভাতেই আজ রাহুল-তেজস্বী ‘ভোট চুরি’ নিয়ে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন। রাহুল বলেছেন, “মহারাষ্ট্রে ওরা নির্বাচন চুরি করেছিল। হরিয়ানায় নির্বাচন চুরি করেছিল। বিহারের পুরোদমে চেষ্টা করবে। ওরা উঠেপড়ে লেগেছে। এসআইআর-এর উদ্দেশ্যই তাই।” অন্য দিকে, সকরা বিধানসভা কেন্দ্রের জনসভায় তেজস্বী মনে করিয়ে দিয়েছেন, পাঁচ বছর আগে এই বিধানসভায় কংগ্রেস প্রার্থী জিতে গিয়েছে বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু জয়ের শংসাপত্র দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ ওঠে। পরে দেখা যায়, কংগ্রেসকে হারিয়ে জেডিইউ প্রার্থী মাত্র ১,৫৩৭ ভোটে জিতে গিয়েছেন। তেজস্বী বলেন, “সকরায় ভোটগণনায় কারচুপি হয়েছিল। শুধু ভোট চুরি নয়। বিধানসভা কেন্দ্রই চুরি হয়ে গিয়েছিল। এ বার সতর্ক থাকতে হবে।” রাহুল বলেছেন, নির্বাচন চুরি ঠেকাতে সবাইকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মহাগঠবন্ধনের পক্ষে ভোট করতে হবে।
আরজেডি, কংগ্রেস নেতাদের ব্যাখ্যা, বিহারে খুব সামান্য ব্যবধানে ভোটের হারজিত ঠিক হয়। পাঁচ বছর আগে, ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচনে ১০টি আসনে ১ হাজারের কম ভোটে হারজিতের ফয়সালা হয়েছিল। ৫২টি আসনে জয়ের ব্যবধান ছিল ৫ হাজারেরও কম। এনডিএ ও মহাগঠবন্ধনের মধ্যে মাত্র ১২,৭৬৮টি ভোটের ফারাক ছিল। যা রাজ্যের মোট ভোটের মাত্র ০.০৩ শতাংশ।
বিহারে এসআইআর নিয়ে রাজধানী পটনায় রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক হয়তো মিইয়ে গিয়েছে। কিন্তু আরজেডি-কংগ্রেসের চিন্তা হল, এসআইআর শুরুর আগে বিহারের মোট ভোটার ছিল ৭.৮৯ কোটি। এসআইআর-এর পরে খসড়া ভোটার তালিকায় ৬৫ লক্ষ ভোটার কমে গিয়ে তা ৭.২৪ কোটিতে নেমে আসে। তার পরে আরও ৩.৬৬ লক্ষ ভোটারের নাম বাদ গিয়েছে। যোগ হয়েছে ২১.৫৩ লক্ষ ভোটার। যার মধ্যে ১৪ লক্ষ নতুন ভোটার। শেষ পর্যন্ত বিহারের ভোটার সংখ্যা ৪৭ লক্ষ কমে ৭.৪২ কোটিতে এসে ঠেকেছে।পাঁচ বছর আগে বিহারে অল্প ভোটের ব্যবধানে মহাগঠবন্ধনকে হারতে হয়েছিল। এ বার ভোটার সংখ্যা কমে যাওয়ায় লড়াই আরও কঠিন হয়ে গেল, মানছেন আরজেডি-কংগ্রেস নেতারা। সেই আশঙ্কা শোনা যাচ্ছে রাহুল-তেজস্বীর কথাতেও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)