Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিভীষিকা কাটছেই না

বন্ধুরা মিলে হলি-ডে হোম লিজ নিয়ে তার সূচনায় পুরী এসেছিলাম ৩০ তারিখে। এসেই শুনি ফণীর আগমনবার্তা। সে ঢুকবে ৩ তারিখ শুক্রবার, তার আগের রাতেই ফিরতি ট্রেনের টিকিট। কাজেই নিশ্চিন্ত।

পাখির চোখে ধ্বংসের ছবি। ছবি পিটিআই।

পাখির চোখে ধ্বংসের ছবি। ছবি পিটিআই।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
(পুরী ফেরত কলকাতার পর্যটক) শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৯ ০৬:০০
Share: Save:

রবিবার সকাল ন’টায় যখন গাড়িতে ওঠা গেল, ভাবলাম এ বার বিভীষিকার অবসান হল।

ধ্বংসপুরীকে পিছনে ফেলে এ বার সোজা বাড়ি। ভুবনেশ্বরের দিকে পিপলির ঝকমকে অ্যাপ্লিকের দোকানগুলো ছাড়িয়ে চন্দনপুর পৌঁছতেই ধাক্কা। সামনে দাঁড়িয়ে সার সার গাড়ি। বেশ উত্তেজনা। পানীয় জলের দাবিতে মানুষ রাস্তা অবরোধ করেছেন। সকাল ছ’টা থেকে রাস্তা বন্ধ। সাড়ে ন’টাতেও না পুলিশ, না প্রশাসনের কেউ। অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়া কোনও গাড়ি যেতে দেবে না। এ দিকে জমতে জমতে রাস্তার দু’দিকে অন্তত ৫০০ গাড়ি।

বন্ধুরা মিলে হলি-ডে হোম লিজ নিয়ে তার সূচনায় পুরী এসেছিলাম ৩০ তারিখে। এসেই শুনি ফণীর আগমনবার্তা। সে ঢুকবে ৩ তারিখ শুক্রবার, তার আগের রাতেই ফিরতি ট্রেনের টিকিট। কাজেই নিশ্চিন্ত। গোল বাঁধল কয়েক ঘণ্টার নোটিসে বৃহস্পতিবারের সব ট্রেন বাতিল হওয়ায়। এ দিকে সন্ধ্যা থেকেই সাগর ফুঁসছে। নাগাড়ে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। সাগরতীরে দেখা পেলাম লম্বা দাড়ি নাগাবাবার। সৈকতে চেয়ারে বসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সাগরের দিকে, আর বলে চলেছেন— শান্ত্ হো যা, শান্ত্ হো যা বেটা! পাল্টা ফোঁস করে সাগর বুঝিয়ে দিচ্ছে— তেমন ইচ্ছা আদৌ নাই তার।

সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছিল। খবর নিয়ে জানলাম, দু’টো স্পেশাল ট্রেন দিলেও তাতে রিজার্ভেশনের ব্যবস্থা নেই। পিলপিল করে মানুষ দৌড়চ্ছেন সেই ট্রেন ধরতে। নিয়মিত ট্রেন বাতিল করে হাজার হাজার কনফার্মড টিকিটের যাত্রীকে অথৈ সাগরে ফেলে স্পেশাল ট্রেন চালিয়ে কী লাভ হল বুঝলাম না।

ফণীর আগের দিন সৈকতে। ছবি: দেবাশিস ভট্টাচার্য।

শুক্রবার আলো ফুটলো সমুদ্রের গর্জন, অঝোর বৃষ্টি আর ঝড়কে নিয়ে। আকাশ অদ্ভুত তামাটে রঙা। ঘড়িতে আটটা বাজবো বাজবো করছে, ঝাঁপিয়ে পড়ল ফণী। হাওয়ার ঘুর্ণি ছুটে বেড়াচ্ছে কখনও পুব থেকে পশ্চিমে, কখনও তার উল্টো দিকে। জানলা দিয়ে দেখছি, অস্থায়ী দোকান-পাট উড়ে কোথায় চলে যাচ্ছে। উপড়ে গিয়ে সটান আছড়ে পড়ছে ল্যাম্প পোস্ট, নারকেল গাছ। সামনের একটা স্টলের কয়েকটি ভারী এলপিজি সিলিন্ডারও উড়ে গিয়ে পড়ল ৭০-৮০ ফুট দূরে! সমুদ্রমুখী ঘরের জানলা ভেঙে পড়ার উপক্রম, দু’তিন জনে চেপে রেখেও দরজাকে বাগে আনা যাচ্ছে না। ভারী ছিটকিনি উপড়ে গেলেই লন্ডভন্ড হয়ে যাবে ঘর। সকাল আটটা থেকে বেলা একটা। তার পরে আস্তে আস্তে ঝড়ের সেই গতি একটু কমল। ধরল বৃষ্টিও। রাস্তায় উঠে আসা সাগর তার গণ্ডিতে ফিরে গেল— ঘর থেকেই দেখলাম। কারেন্ট তো ছিল না, অচল হল মোবাইল ফোনও।

বিকেলে বেরিয়ে দেখলাম ধ্বংসের মাত্রা। গোটা মেরিন ড্রাইভ হারিয়ে গিয়েছে ফুট তিনেক বালির নীচে। অস্থায়ী দোকানপাট, কাঁচা বাড়ি— চিহ্নমাত্র নেই কোনওটার। বড় বড় হোটেলগুলোর কাচের কেয়ারি তো ভেঙে ছত্রখানই, ঝড়ের মারে উঠে গিয়েছে দেওয়ালের রং-পলেস্তারাও! মানুষের হাহাকার। কারও দোকান গিয়েছে, কারও বসত বাড়ি।

প্রশাসন গাছ কাটা শুরু করলেও রবিবার পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ ফেরেনি। ফেরা সম্ভবও নয়। পুরী ও সংলগ্ন এলাকার গোটা কতক ল্যাম্প পোস্টই শুধু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে। ছিঁড়ে উধাও তারেরা। নতুন করে বিদ্যুৎ পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে পুরীর জন্য।

এ বার ফেরার চিন্তা। সড়ক বন্ধ। টিকিট মিলল রবিবার রাতের ট্রেনের। শনিবার পুরী স্টেশন চত্বরে পা দিতেই বুকটা ধক করে উঠল। উড়ে গিয়েছে শেড, তছনছ প্ল্যাটফর্ম। কলাগাছের মতো ঘাড় মটকে পড়ে সিগন্যাল পোস্ট। ডিআরএম জানালেন, আরও তিন দিন ট্রেনের আশা করবেন না।

সড়ক খুলেছে। অগত্যা গাড়ি ভাড়া। দেড় গুণ বেশি টাকা নিলেও কলকাতায় ঢুকবে না। নামাবে হাওড়া স্টেশনে। তাই সই।

অবশেষে রবিবার সকালে গাড়ি ছাড়লেও অবরোধ চন্দনপুরে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছি সবাই। কত জায়গাই তো বেড়িয়েছি, এমন বিভীষিকার সফর এই প্রথম।

বেলা তখন ১২টায় গাড়ি নড়ল। তার পরে অবশ্য আর থামতে হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Fani ফণী Horror Puri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE