মে মাসে ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষবিরতির প্রথম ঘোষণাটি করেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘মধ্যস্থতার’ কৃতিত্ব নিয়ে চাপানউতোর চললেও, সংঘাত বন্ধে আমেরিকার ভূমিকা যে অগ্রগণ্য তা নিয়ে সংশয় ছিল না আন্তর্জাতিক শিবিরের।
তবে কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, সপ্তাহ গড়ানোর আগেই তড়িঘড়ি ভারত-পাক সংঘাত বন্ধের জন্য আমেরিকার ঝাঁপানোর পিছনে রয়েছে বৃহত্তর ভূকৌশলগত নকশা। মনে করা হচ্ছে, ইরানকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা মে মাসে (বা তার আগে থেকেই) করা হয়েছিল। ইজ়রায়েলের সঙ্গে রণনীতি নিয়ে কথাও শুরু হয়েছিল আমেরিকার। ইরানের উপরে হামলার আগে পাকিস্তানকে শান্ত করা অগ্রাধিকার ছিল ওয়াশিংটনের, এমনই মনে করা হচ্ছে। তাই এত তাড়া এবং বারবার ট্রাম্পের মনে করিয়ে দেওয়া যে তিনিই মধ্যস্থতাকারী।
প্রশ্ন উঠছে, ইজ়রায়েলের ইরান আক্রমণের আগে এই সংঘাত বন্ধের কী এমন তাগিদ ছিল আমেরিকার? বিশেষজ্ঞদের মতে, তাগিদটা ভারতকে নিয়ে নয়, বরং পাকিস্তানকে বিপন্মুক্ত করা যাতে তাদের সামরিক শক্তি, গোয়েন্দা বাহিনীকে প্রয়োজনে কাজে লাগানো
যায়। অতীতে আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে বার বার ব্যবহার করেছে পেন্টাগন এবং আমেরিকার তৎকালীন সরকার। ইসলামাবাদও তাদের ভূকৌশলগত অবস্থানকে মূলধন করে সহায়তামূল্য আদায় করেছে। ইরানের ক্ষেত্রেও কৌশল তার কাছাকাছিই বলে মনে করা হচ্ছে। গত কাল পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের মধ্যাহ্নভোজ একই সঙ্গে অভিনব এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এটা ঠিকই যে, এর আগে তিন পাক সেনাপ্রধান— ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান, জেনারেল জিয়াউল হক এবং জেনারেল পারভেজ মুশারফের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্টরা। তবে তাঁরা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পরেই সেই বৈঠক হয়েছিল। এই প্রথম কোনও পাক সেনাপ্রধান, যিনি ঘোষিত ভাবে কোনও রাজনৈতিক পদে নেই, তাঁর সঙ্গে বৈঠক করলেন ট্রাম্প। পাকিস্তান ইরানের প্রাচীন বন্ধু রাষ্ট্র, সে দেশের পরমাণুভান্ডার তৈরির আদি ইতিহাসে পাকিস্তানের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। এ হেন রাষ্ট্রকে বিভিন্ন কূটনৈতিক টোপ দিয়ে যদি ইরানের পাশ থেকে সরিয়ে দেওয়া ও আমেরিকার পক্ষে রাখা যায়, তা হলে ট্রাম্পের লাভ। মধ্যাহ্নভোজের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেটাই।
মুনিরের ক্ষেত্রেও এ এক বিরল সম্মান এবং পাকিস্তানের মতো দেশে সেনাপ্রধানের হোয়াইট হাউসের কাছ থেকে পাওয়া আমন্ত্রণ তাঁর রাজনৈতিক এবং রণনৈতিক গুরুত্ব এক ধাপে অনেকটাই বাড়িয়ে দিল বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্রের এ-ও বক্তব্য, ইরান যুদ্ধে আমেরিকার পাশে থাকতে আপাতত এবং মোটের উপর সম্মত আসিম মুনির, তা প্রকাশ্যে পাকিস্তান থেকে যে বার্তাই দেওয়া হোক না কেন। মুনিরের দু’টি শর্ত ছিল। প্রথমত, ফিল্ড মার্শাল পদে তাঁকে উন্নীত করতে আমেরিকার সমর্থন তাঁর প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয়ত, তিনি চেয়েছিলেন হোয়াইট হাউস তাঁকে ডাকুক। আপাতত পরিস্থিতি যা, তাতে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ কার্যত পুতুল প্রধানমন্ত্রীতে পরিণত হলেন, এমনই মনে করা হচ্ছে। কারণ, সামরিক অভ্যুত্থান ছাড়াই পাকিস্তানে প্রভাব সবচেয়ে বেশি বাড়ছে মুনিরের।
তা হলে ভারতের অবস্থান কী হবে? কূটনৈতিক শিবির বলছে, ভারতকে এই মুহূর্তে ভূকৌশলগত বিচারে ওয়াশিংটন কতটা গণ্য করছে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ভারতের বাজার ধরা এবং নিজেদের সুবিধাজনক শর্তে বাণিজ্যচুক্তি করার প্রয়োজনীয়তা আমেরিকার রয়েছে ঠিকই। কিন্তু আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি ও তাঁর ভাইপো সাগর আদানির বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে আমেরিকার মামলা-সহ বেশ কিছু চাপ তৈরির অস্ত্র ওয়াশিংটনের কাছে রয়েছে।
মুনিরের মধ্যাহ্নভোজের পরে ভারত আমেরিকা-নীতিতে কোনও বদল আনবে কি না, সেটাও দেখার। মোদী আগে অনেক বার বলেছেন, সন্ত্রাসবাদী এবং তাদের মদতদাতাকে এক চোখে দেখা হবে। গত কালও তিনি একই কথা বলেছেন। তা হলে পহেলগাম কাণ্ডের দু’মাসের মধ্যে ‘পাকিস্তান প্রেমিক’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যনীতি কোন ভাষ্যের আড়ালে চালাবে সাউথ ব্লক, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)