Advertisement
E-Paper

দুর্যোগ, হিংসাকে হারিয়ে শৈশব আগলাচ্ছে ভূস্বর্গ

বারামুলার ছোট্ট জনপদটার নাম পালহালান। লোকে বলে, কাশ্মীরের কন্দহর! মিড্ল স্কুলের অদূরেই পাঁচমিশালি দোকানের দেওয়ালে স্প্রে-পেন্ট করা ছিল কথাটা। ‘লাইফ ইজ অ্যান আউট্ল্য’!

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৬ ০৯:৫৭
অনন্তনাগের স্কুলে চলছে পড়াশোনা। —নিজস্ব চিত্র

অনন্তনাগের স্কুলে চলছে পড়াশোনা। —নিজস্ব চিত্র

বারামুলার ছোট্ট জনপদটার নাম পালহালান। লোকে বলে, কাশ্মীরের কন্দহর! মিড্ল স্কুলের অদূরেই পাঁচমিশালি দোকানের দেওয়ালে স্প্রে-পেন্ট করা ছিল কথাটা। ‘লাইফ ইজ অ্যান আউট্ল্য’!

পারিপার্শ্বিকের চাপে শৈশব যাতে পথভ্রষ্ট হয়ে বিবাগী না হয়ে যায়, তার জন্যই জোর লড়াই চলছে ভূস্বর্গে। এই লড়াইয়ে বোমা-বারুদ-বন্দুক নেই। হাতিয়ার সদিচ্ছা এবং সহযোগিতা।

হিংসার মেঘ কাশ্মীরে শৈশবের উপরে কালো ছায়া ফেলেছে বারবার। কেউ বিদ্রোহী, কেউ জেলে বন্দি। কেউ আবার সাজার মেয়াদ কাটিয়ে বাইরে এসেও অবসাদগ্রস্ত। সে সব পরিবারের শিশুদের স্কুলে টেনে এনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া বরাবরের চ্যালেঞ্জ এই তল্লাটে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক কালে হিমালয়ের কোলে ঘটে যাওয়া ভয়াল ভূমিকম্প এবং বিধ্বংসী বন্যার দাপট। স্কুল লন্ডভন্ড হয়েছে, দরজা-জানলা ভেসে গিয়েছে। প্রাণভয়ে স্থানান্তরী হতে হয়েছে বহু মানুষকে। এই যাবতীয় প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করেই শৈশবকে তার নিজের জায়গা ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই ধীরে ধীরে গতি পেয়েছে জম্মু ও কাশ্মীরের জেলায় জেলায়।

সিংহপোরার আশরাফ লোন জানে, বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়ানোর মানে কী। বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন প্রায় ভুলতে বসেছিল ১৪ বছরের কিশোর। প্রথমে অশান্তির জালে বিপন্ন এবং তার পরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কায় তার গরিব ঘর কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিল। জেলার শিশু সুরক্ষা কমিটির (সিপিসি) উদ্যোগে তাদের ঘরে যখন এনে দেওয়া হয়েছে কার্পেট বোনার একটা ইউনিট, মায়ের সঙ্গে সে কাজে হাত লাগিয়েছে আশরাফ। কার্পেট তৈরির উপার্জন থেকে সংসার আবার গড়াচ্ছে, স্কুলেও ফিরে গিয়েছে নবম শ্রেণির ছাত্র। নিজের লড়াই এবং তাতে সহমর্মিতার গল্প শোনাতে শোনাতে বাবা বসির আহমেদ লোনের পাশে দাঁড়িয়ে আশরাফ এখন আবার বলতে পারে, ‘‘আমি ডাক্তার হতে চাই। শ্রীনগর ছাড়া কাশ্মীরের সর্বত্র ভাল ডাক্তার নেই।’’

বসির-আশরাফদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প যদি একটা পরিবারের ছোট পরিসরে হয়, অনন্তনাগের বিজবেহরায় সরকারি মিড্ল স্কুলে ঢুকলে তা হলে একটা আস্ত এলাকার ভরসা ফিরে পাওয়ার ছবি! প্রথমে ভূমিকম্প, পরে বন্যার অভিঘাত ধসিয়ে দিয়েছিল গোটা স্কুলকে। প্রধান শিক্ষক ইমতিয়াজ আলমের কথায়, ‘‘জল ঢুকে সব শেষ করে গিয়েছিল। বাচ্চারা কবে ফিরতে পারবে, কিছুই ঠিক ছিল না। রাজ্য সরকার ও একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় ধীরে ধীরে আবার দাঁড় করানো হয়েছে স্কুলকে। অন্য জায়গা থেকে পুরনো জিনিসপত্র এনেই বেশির ভাগ পুনর্নির্মাণের কাজ হয়েছে।’’ উপরি হিসাবে গ্রামের স্কুলে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়াতে লাগানো হয়েছে ওয়াশ স্টেশন। মেয়েদের শৌচাগারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে অভিনব বিন, যার মধ্যে ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন পুড়িয়ে দেওয়া যায়। বেসরকারি ওই সংস্থার জম্মু ও কাশ্মীরের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর শরিফ ভট্টের কথায়, ‘‘বন্যার পরে রাজ্য সরকার আমাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছিল। এই এলাকাতেই আমরা ৬টা স্কুল এ ভাবে পুনর্গঠন করেছি। এমনিতে সরকারি স্কুলে ওয়াশ স্টেশন ছিল না।’’

নতুন করে গড়ে তোলার পরে তাকে রক্ষা করার কাজও চলছে নতুন তাগিদে। প্রধান শিক্ষক ইমতিয়াজ যেমন নিজেই স্কুলের সাফাই অভিযানে হাত লাগান। তাঁর যুক্তি, বহু পরিশ্রমে যাকে ফের দাঁড় করানো গিয়েছে, তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সকলের এগিয়ে আসাই স্বাভাবিক। সাফাইকর্মীর কাজ বলে প্রধান শিক্ষক হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না! আবার অনন্তনাগের উরাখেল গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রী ইফরাত তার নিজের স্কুলকে সাফসুতরো রাখতে বন্ধুদের সঙ্গে হাত মেলায়। তার কথায়, ‘‘জল যখন স্কুলের জানলার উপর পর্যন্ত উঠে এসেছিল, আমরা সব ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিলাম। আর কোনও দিন পড়াশোনা করতে ফিরতে পারব, ভাবতেই পারতাম না! এখন স্কুলে আসতে ভাল লাগে।’’ পুলওয়ামা জেলা স্কুলে গেলেও সেই একই দৃশ্য। শিক্ষক, পড়ুয়াদের মুখে একই কথা।

প্রকৃতির রোষ থেকে রক্ষা পাওয়ার পাশাপাশি হিংসার ভ্রূকুটি থেকে শিশুদের আগলে রাখার প্রয়াসও

একই ভাবে জারি এই মুহূর্তে কাশ্মীর জুড়ে। কারগিলে যেমন স্কুলের নীচে আস্ত বাঙ্কার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে! যাতে গোলা-বর্ষণের হাত থেকে পড়ুয়াদের মাথা বাঁচানোর ব্যবস্থা করা যায়। নানা টুকরো-টাকরা ঘটনায় আহত শিশুদের মানসিক আঘাত কাটিয়ে তোলার চেষ্টাতেও খামতি নেই। বেসরকারি সংস্থাটির জেনারেল ম্যানেজার (যোগাযোগ) দেবেন্দ্র টাকের বক্তব্য, ‘‘এক একটা এলাকায় একেবারে শেষ শিশুটির কাছে পৌঁছনোও আমাদের লক্ষ্য।’’

শৈশবকে বিবাগী, অপরাধী হতে না দেওয়াই এখন ভূস্বর্গের সংগ্রাম!

kashmir disaster
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy