সাড়ে ছ’বছর আগে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে হারের পুরো দায় নিয়ে কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। প্রবীণ নেতাদের অনেকেই তাঁর সঙ্গে লড়াইয়ে কাঁধ মেলাননি বলে রাহুলের অভিযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও লোকসভা নির্বাচনে হারের পুরো দায় নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন।
বিহারে কংগ্রেসের ভরাডুবির পরে দলের মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, যে রাহুল নিজে হারের দায়িত্ব নিতেন, এখন তিনি দলের ব্যর্থতার দায় নির্ধারণ করতে চাইছেন না! উল্টে ভোট চুরির অভিযোগ তুলে কংগ্রেসের বাকি সব খামতি আড়াল করছেন।
বিহারে কংগ্রেস ৬১টি আসনে লড়ে মাত্র ৬টিতে জিতেছে। এর আগে হরিয়ানায় কংগ্রেসের নিশ্চিত জয় হাতছাড়া হয়েছিল। তারও আগে মহারাষ্ট্র, দিল্লিতে কংগ্রেস হেরেছে। ফলে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন কমার পরে বিরোধী শিবিরের পালে যে হাওয়া লেগেছিল, তা উধাও। কংগ্রেসের এক নবীন নেতার বক্তব্য, ‘‘গত ১৮ মাসে কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে হেরেছে। তার পরেচারটি বিধানসভা নির্বাচনে হেরেছে। কিন্তু রাহুল কারও জবাবদিহি চাননি। কংগ্রেসের সাংগঠনিক সম্পাদক কেসি বেণুগোপাল বহাল তবিয়তে নিজের পদে রয়েছেন। কোনও রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত নেতা বা প্রার্থী বাছাই কমিটির চেয়ারম্যানকে জবাবদিহি করতে হয়নি।’’
এই সুযোগ নিয়েই বিজেপি অভিযোগ তুলেছে, রাহুলের ২০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কংগ্রেস ৯৫টি ভোটে হেরেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলছেন, কংগ্রেসে এ বার ভাঙন ধরবে। রাহুলকে নিয়ে তরুণ নেতারাই অসন্তুষ্ট। এআইসিসি-র প্রাক্তন সম্পাদক আশিস দুয়ার মতে, ‘‘এখন অভিযোগ তোলার নয়, আত্মসমীক্ষা করার সময়। কেন এত জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি কংগ্রেস ছাড়ছেন বা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন, তা ভাবা দরকার।’’
কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, রাহুল ২০০৪ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে আসেন। ২০০৭ সালে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক হন। যুব কংগ্রেস ও ছাত্র কংগ্রেসের দায়িত্ব নেন। ২০১০ থেকে তিনি কংগ্রেসের সহ-সভাপতি। ২০১৭-য় কংগ্রেসের সভাপতি হলেও ২০১৯-এ ওই পদ থেকে ইস্তফা দেন। তার পরে সনিয়া গান্ধী ও মল্লিকার্জুন খড়্গে কংগ্রেসের শীর্ষপদে বসলেও রাহুল ও তাঁর ‘টিম’-ই যে দল চালায়, তা সকলের জানা। ফলে দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার দায় রাহুলের পক্ষে এড়ানো সম্ভব নয়।
গতকালই রাহুল অভিযোগ তুলেছিলেন, বিহারের নির্বাচন প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ ছিল না। আজ সকালে কংগ্রেস সভাপতি খড়্গের সঙ্গে রাহুল ও দলের নেতাদের বৈঠকের পরেও কংগ্রেস ভোট চুরি-র অভিযোগেই অনড় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা নিয়ে তথ্যপ্রমাণ প্রকাশ্যে আনা হবে। কংগ্রেসের এক প্রবীণ নেতা বলেন, ‘‘ভোট চুরি বা ভোটার তালিকায় কারচুপি হতেই পারে। কিন্তু তা দিয়ে দলের বাকি ব্যর্থতা ধামাচাপা দিলে চলবে না।’’ তাঁর বক্তব্য, হরিয়ানায় বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস জিততে পারেনি। নেতারা নিজের শিবিরের লোকদের টিকিট দেওয়া নিয়ে লড়াই করছিলেন। এখন ‘ভোট চুরি’-র ফলে হরিয়ানায় কংগ্রেসকে হারতে হয়েছে বলে রাহুল দাবি করছেন। বাকি সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হয়নি। মহারাষ্ট্রেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খেসারত দিতে হয়েছে। কিন্তু সে সব রাজ্যে হারের জন্য দায়ী নেতারা ‘ভোট চুরি’-র কথা বলে দায় ঝেড়ে ফেলছেন।
বিহারেও কংগ্রেসের প্রার্থী বাছাই নিয়ে প্রবল অসন্তোষ ছিল। টিকিট বিক্রির অভিযোগও উঠেছে। রাহুল শিবিরের নেতারা বলছেন, তাঁর পক্ষে সব কিছুর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। কংগ্রেসের একটি সূত্রের পাল্টা যুক্তি, অধিকাংশ রাজ্যেই যে কংগ্রেসের প্রার্থীদের একাংশের টিকিট বিক্রি হয়, তা ‘ওপেন সিক্রেট’। সেই প্রার্থী তালিকা কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি মঞ্জুর করে। শীর্ষ নেতাদের কাছে সংগঠনের ছবি স্পষ্ট না থাকায় রাজ্যের নেতারা টিকিট বিক্রির সুযোগ পেয়ে যান। রাহুল ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ করে লোকসভা নির্বাচনে কিছুটা সাফল্য পেয়েছিলেন, বিহারে ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ করে ভোট কুড়োনোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভোট চুরির অভিযোগ মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলেনি। কংগ্রেসকে ভোট চুরির মোকাবিলা সাংগঠনিক ভাবে করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে প্রচার করে ভোট মিলবে না। কোন বিষয়ে মানুষের সাড়া মিলবে, তা বুঝতে হবে। শশী তারুরের মতো কংগ্রেস নেতারা ইতিমধ্যেই অভিযোগ তুলেছেন, দল বড্ড বেশি বামপন্থার দিকে ঝুঁকেছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)