Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
খরার রাজ্যে

রুদ্ররোষে মুখ লুকিয়েছে গাছের ছায়াও!

পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৪৫% খরার কবলে। জলের কাছে বন্ধক জীবন কাটছে কী ভাবে?মহারাষ্ট্রের বিদর্ভের যে-দিকেই যাওয়া যাক না কেন, ছবিটা কমবেশি এক। একটি গোটা এলাকা যেন ক্রমশ মরুরাজ্যের দিকে এগোচ্ছে।

পিপরিয়া গ্রামে গবাদি পশুর জন্য জলের ভাঁড়ার। নিজস্ব চিত্র

পিপরিয়া গ্রামে গবাদি পশুর জন্য জলের ভাঁড়ার। নিজস্ব চিত্র

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
নাগপুর শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০১৯ ০২:২৫
Share: Save:

বেলা ১১টা বাজার আগেই রাস্তাঘাট কার্যত ফাঁকা হয়ে যায়। প্রবল গরম হাওয়া। রাস্তার দু’পাশে যত দূর চোখ যায়, শুধুই ধু-ধু প্রান্তর। রুক্ষ মাটি দেখে মনে হয়, যেন মরুপ্রান্তরে এসে পড়েছি। শীর্ণকায় পাতাহীন গাছগুলো যেন আদতে গাছের কঙ্কাল!

মহারাষ্ট্রের বিদর্ভের যে-দিকেই যাওয়া যাক না কেন, ছবিটা কমবেশি এক। একটি গোটা এলাকা যেন ক্রমশ মরুরাজ্যের দিকে এগোচ্ছে। এগোচ্ছে যে, তার ইঙ্গিত পেয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের আধিকারিকেরাও। তাঁদের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বিদর্ভের বেশ কিছু এলাকার জমি আধা-মরু হয়ে গিয়েছে। ভূগর্ভের জলস্তর এতটাই নীচে নেমে গিয়েছে যে, তা চট করে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কম। মাটিও কার্যত ফোঁপরা হয়ে গিয়েছে। তার ফলে উপর থেকে জল ঢাললেও মাটি পর্যাপ্ত ভাবে ভিজছে না।

এই এলাকা এমন কেন? বারবার এলাকাটি কেন পড়ছে খরার কবলে?

ভূগোলবিদেরা বলছেন, বিদর্ভের এক দিকে দাক্ষিণাত্য মালভূমি এবং অন্য দিকে সাতপুরা পর্বত। ফলে ভৌগোলিক ভাবেই এখানকার মাটি রুক্ষ। তবে কৃষ্ণমৃত্তিকা বলেই কার্পাস তুলো এবং কিছু ডালের চাষ হয়। কিন্তু বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগর— দু’টিই দূরে। ফলে সমুদ্র থেকে জলীয় বাষ্প ঢোকে না। তার উপরে মাটি এবং বায়ুমণ্ডলে যেটুকু জলীয় বাষ্প থাকে, রোদের তীব্র তেজে তা-ও উবে যায়। মেঘ সে-ভাবে দানা বাঁধতে পারে না। সব মিলিয়ে এই এলাকায় সার্বিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তুলনায় কম।

আরও পড়ুন: বাংলার গুরুত্ব, লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর

বিদর্ভের নানান প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল, বর্ষাকালেও আকাশ ঘন নীল। তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই মেঘ দেখতে ভাল, কিন্তু তা থেকে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তীব্র রোদে ডালিমের খেত শুকিয়ে কাঠ। কলাবাগান, পেঁপে বাগান ছারখার হয়ে গিয়েছে। গাছের ছায়াও যেন খুঁজে পাওয়া যায় না।

“গাছের ছায়া পাবেন কোথায়?” নাগপুর থেকে ওয়ার্ধা যাওয়ার পথে প্রশ্নের ছলে খেদোক্তি করলেন গাড়িচালক কমলেশ চৌধুরী। জানালেন, দু’পাশে যত বড় বড় গাছ ছিল, রাস্তা চওড়া করার জন্য সবই কেটে ফেলা হয়েছে। এই ভাবে কাটা পড়েছে আরও অনেক গাছ। পরিবেশবিদেরা বলছেন, বৃষ্টিপাতের জন্য গাছ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত খরাপ্রবণ এলাকায় গাছ বেশি দরকার। সেই গাছই যদি কেটে ফেলা হয়, তা হলে তো বৃষ্টি আরও কমে যাবেই।

বিদর্ভে প্রাকৃতিক জলের জোগান বলতে বৃষ্টিই। কারণ, এই এলাকার নদীগুলি বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী। গঙ্গার মতো বরফগলা জলের নদী এখানে নেই। তাই বৃষ্টি কম হলে নদীও শুকোবে। বিদর্ভে ওয়ার্ধা, কানহান, বোরের মতো ছোট, বড় সব নদীই শুকিয়ে কাঠ। যে-দিকে চোখ যায়, শুধুই বালি আর বালি। সেচের জন্য জলাধার তৈরি হয়েছিল বটে। কিন্তু এ বছর বর্ষা দেরি করায় সেই জলাধারের জলেও ক্রমশ টান পড়ছে। বাড়ছে পানীয় জলের সঙ্কটের আশঙ্কা।

কৃষি মন্ত্রকের এক আধিকারিক বলছেন, জলের এমন হাহাকার কয়েক বছর আগেও ছিল না। চাষের ভুল পদ্ধতির জন্যই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিদর্ভে চিরকালই কার্পাস বা ডালশস্যের মতো অর্থকরী ফসলের চাষ হয়। বেশ কিছু বছর আগে থেকেই জিনপ্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি কার্পাসের বীজ দিয়ে চলছে চাষ। বেশি লাভের লোভে মাটির তলা থেকে নির্বিচারে জল তোলা হয়েছে। তার ফলেই ভূগর্ভের জলস্তর নেমেছে। বৃষ্টির ঘাটতি থাকায় তা পূরণ হয়নি। তার ফলে মাটির তলাতেও ঘাটতি ক্রমশ বেড়েছে। বিদর্ভের বিভিন্ন জেলার সরকারি আধিকারিকেরা স্বীকার করছেন, এই জলস্তর নেমে যাওয়ার ফলে সেচ প্রকল্প কার্যকর হয়নি। বিদর্ভের কৃষক নেতা জনরাও নাগমোতে বলছেন, শুখা এলাকায় ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠেছে। তারাও মাটি থেকে নির্বিচারে জল তুলছে। সঙ্কট বাড়ছে সেই কারণেও।

কারণ যা-ই হোক, সঙ্কট যে বাড়ছে, সরকারি আধিকারিক থেকে কৃষক নেতা— সকলেই তা মানছেন। এই সঙ্কট থেকে বেরোনোর উপায় কী?

সদুত্তর মিলছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drought Vidarbha Deforestation Water
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE