স্কটিশ ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল দলাই লামার মন্দির সুগলাগখং নিয়ে ১৬ বছর আগে ‘দ্য মংকস টেল’-এ লিখলেন, ‘আমাদের চারপাশে তিব্বতি তীর্থযাত্রীরা প্রার্থনাকক্ষে প্রদক্ষিণরত। কেউ গোড়ালি পর্যন্ত ভেড়ার চামড়ার চুবা পরে। স্পষ্টতই পশ্চিম তিব্বত থেকে আসা যাযাবর, সুউচ্চ তুষার গিরিপথ পেরিয়ে সদ্য আসা। ধূপ এবং মাখনের প্রদীপের তীব্র গন্ধে বাতাসে মিশেছিল প্রার্থনার গুঞ্জন।’
পরিস্থিতি বদলেছে। তখনও প্রাণশক্তিতে ভরপুর দলাই লামার দেখা পাওয়া ওই মন্দিরে ছিল সহজ। এখন নবতিপর সন্ন্যাসী। শ্রবণশক্তি কমেছে, কথাও বলেন খুবই কম, অত্যন্ত নিচু স্বরে। তিব্বত থেকে এখানে আসা মানুষের সংখ্যা কমেছে চিনের দমননীতিতে।
ওই মন্দিরের মাখন প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের সমাহিত প্রার্থনা দৃশ্য এবং অবলোকিতেশ্বর স্বর্ণমূর্তি ছাড়িয়ে উল্টো দিকের চত্বরে বিরাট গেটটি দিয়ে মাছি গলার উপায় নেই। ভিতরে তাঁর বাসস্থান। উপায়রহিত ভাবে ভিজে যাচ্ছি ভোরবেলা থেকে। যে সময়ে দলাই লামার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিস আসতে বলেছিল, তার থেকে সময় বদলেছে। কিন্তু যে কোনও সময়ে ডাক আসতে পারে, জায়গা ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন নেই আমাদের। অর্থাৎ আমার এবং সঙ্গে গোটা কুড়ি বিভিন্ন রাষ্ট্রের জনা পঁচিশেক দর্শনার্থীর। কারণ, ‘হিজ় হোলিনেস’-এর মুখোমুখি হয়ে আশীর্বাদ পাওয়ার এই সুযোগ আসবে না বারবার। ভারত-তিব্বত সমন্বয় আধিকারিকের উদ্যোগে আমরা কয়েক জন সাংবাদিক অল্প আয়াসেই এই সুযোগ পেয়েছি। লাইনে অপেক্ষারত আমেরিকার প্রকৌশলী স্মিথ ব্যারেট জানাচ্ছেন, ছ’মাস আগে চিঠি লিখে দর্শন চেয়েছিলেন। সুযোগ এসেছে আজ।
চিন অধিকৃত তিব্বতে কোনও ঘরে দলাই লামার নামোচ্চারণ নিষিদ্ধ, তাঁর বই বিপজ্জনক আজও। তাঁর সেই আত্মজীবনী, ধর্মশালায় এসে উপহার পেয়েছি। একটা বন্দুক কাঁধে ফেলে, পরিচয় এড়াতে নিজের চশমা খুলে, নরবুলিংকর প্রাসাদ থেকে ৫২ জন সন্ন্যাসীর সঙ্গে মিশে পালিয়ে আসার রোমহর্ষক বর্ণনা। ১৯৫৯ সালের ১৭ মার্চ চিনা সেনার দু’টি মর্টার শেল নরবুলিংকা প্রাসাদের পাশে জলাভূমিতে আছড়ে পড়েছিল। সেই রাতেই দলাইয়ের ভারতের বিপদ-সঙ্কুল রাস্তায় যাত্রা শুরু।
এত ক্ষণে ডাক পড়েছে তাঁর বাসস্থানের সংলগ্ন অফিস থেকে। পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রথমে একটা ছোট ঘরে অপেক্ষা, তারপর ভারতীয় সেনার তিব্বতি জওয়ানদের শরীর তল্লাশি। এমন তল্লাশির অভিজ্ঞতা কিছুটা ইজ়রায়েলের দূতাবাস ছাড়া কোথাও হয়নি। একটি পেন বা লেখার প্যাড দূরস্থান, বাড়তি সুতোও নিয়ে যাওয়া যাবে না ভিতরে। এক বার নয়, বারবার, পর পর তিনটি অপেক্ষার ঘর বদলানোর মাঝে একবার করে তল্লাশি। মনে পড়ল, গতকাল মানবাধিকার সংস্থার অধিকর্তার সতর্কবাণী। ধর্মশালা ভরে রয়েছে চিনা গোপন দূতে। তাঁদের মধ্যে ঘাতক থাকাও অসম্ভব নয়।
চিন্তাসূত্র ছিঁড়ল এক বিশাল হলঘরে এসে। মাঝখানে ছোট্ট লাল মঞ্চে একটি চেয়ার সিংহাসনের মতো। চারপাশে ভারতীয় সেনা, তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা। উৎকণ্ঠায় হৃদ্পিণ্ড গলার কাছে। হয়তো এই ঘরেই যে কোনও সময়ে ঢুকবেন দলাই। কিন্তু সেখান থেকেও কয়েকশো মিটার দূরে একটি কাচের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। জেমস বন্ডের মতো সপ্রতিভ, চটপটে অথচ প্রবীণ নীল স্যুট পরা তিব্বতি নিরাপত্তা অফিসার প্রথম কক্ষ থেকেই আমাদের সঙ্গে বারবার নাম ঝালিয়ে নিচ্ছেন। লঘু পায়ে দৌড়চ্ছেন, মুখে হালকা হাসি। বোঝাই যাচ্ছে, জ্যাকেট থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বার করতে তিলার্ধ সময় লাগবে না তাঁর!
মিনিটকে যখন ঘণ্টা মনে হচ্ছে, তখনই প্রতীক্ষা মুক্তি। ‘জেমস বন্ড’ এসে জানালেন, লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হবে, অদূরের একটি গাড়ি বারান্দার সামনে। প্রত্যেকের হাতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা হল, কারণ দলাই লামা স্পর্শ করেন প্রত্যেককে।
বৃষ্টি ধরে আসছে। একটি ব্যাটারিচালিত গাড়িতে আবির্ভূত হলেন তিনি। লাসার প্রাসাদ থেকে অসমের তেজপুরের প্রান্তে পৌঁছতে ৩৩ দিন লেগেছিল যাঁর। পদব্রজে, ভয়ঙ্কর তুষারঝড় সহ্য করে, কঠিনতম যাত্রার শেষ রাতে যখন নিশ্চিন্ত ঘুমিয়েছিলেন তখনও বৃষ্টি এসে ভাসিয়েছিল। লিখছেন, ‘এই প্রথম একটি তাঁবু পেয়েছিলাম নিশ্চিন্তে ঘুমানোর। কিন্তু তাতে ফুটো ছিল, আর রাতে অঝোর বর্ষা। ভোর তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেল। বিছানাটা সরিয়ে জলের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করলাম, লাভ হল না। বাকি রাতটুকু জেগে অসুস্থহয়ে পড়লাম।’
জনা পঁচিশেকের লাইন দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বৃষ্টি কেটে গত পাঁচ দিনে এই প্রথম রোদ উঠল ততক্ষণে। গাড়ি বারান্দার নীচে একটি চেয়ারে চার জন সন্ন্যাসী ধরাধরি করে বসিয়েছিলেন লামাকে। সামনে পৌঁছে চিৎকার করেই বললাম, ‘‘আমি সাংবাদিক। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছি।’’ আকাশের আলোটা এ বার তাঁর মুখে। বৌদ্ধদের বিশ্বাস মতে, যিনি বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের চতুর্দশতম অবতার। গোটা বিশ্বের শান্তির পথপ্রর্দশক, অসাম্প্রদায়িকতার পতাকাধারী। হাত বাড়িয়ে গালে আঙুল স্পর্শ করলেন দলাই লামা, তারপর মাথায়। চোখে চোখ রাখলেন। অস্ফুটে আশীর্বাদ জানালেন মন্ত্রোচ্চারণে। আমি দেখলাম তাঁর স্বর্গীয় হাসি।
এক আনন্দতরঙ্গ তখন বইছে সর্বত্র।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)