মানুষটির উচ্চতা ছিল মাত্র পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চি। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ছিলেন প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস। তার মধ্যেই নানা পদক্ষেপের জন্য হয়ে উঠেছিলেন ‘মানুষের মুখ্যমন্ত্রী’। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গদি ছাড়তে হলেও জনপ্রিয়ই ছিলেন কালিখো পুল। আজ মুখ্যমন্ত্রী আবাসে তাঁর ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধারের পরে তাই বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন অরুণাচলের মানুষ।
অরুণাচলের সাম্প্রতিক টানটান রাজনৈতিক চিত্রনাট্যে প্রাক্তন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী নাবাম টুকিকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিলেন পুল। ২১ জন বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসি, ১০ জন বিজেপি ও ২ জন নির্দল বিধায়কের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। তবে পরে সেই সরকারের বৈধতা খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
কিন্তু সাড়ে পাঁচ মাস মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার সময়ে পুল আম জনতার কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আনজাও জেলার কামান মিশমি উপজাতির সদস্য পুলকে বহু বছর ধরে দারিদ্রের সঙ্গে লড়তে হয়েছে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারান তিনি। আসবাব তৈরি করে, বেড়া বেঁধে পেট চালাতেন। অভাবের জ্বালায় ছোটবেলাতেও কয়েক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে নিজেই স্বীকার করেছিলেন। স্থানীয় জেলাশাসকের দয়ায় স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। টিউশন ফি দেওয়ার টাকাও না থাকায় স্কুলে নৈশ চৌকিদারের কাজও করেছেন।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ৪০০ টাকার বেড়া বেঁধে ঠিকাদারি শুরু করেন পুল। ৩৭টি সরকারি ভবন, ১২টি সেতু ও কয়েকশো কিলোমিটার সড়ক তৈরি করে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ঠিকাদার হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়ান। ২৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ২২ বছরই ছিলেন মন্ত্রী। ঘনিষ্ঠদের মতে, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কোনও দিনই হারাননি পুল। বরং দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে উঠে আসায় গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে বরাবর গুরুত্ব দিয়েছেন।
অনাথ বা দরিদ্রদের জন্য বরাবরের সহানুভূতিশীল পুল জনতার দরবার শুরু করেন। সেখানে তাঁর কাছে এসে খালি হাতে কেউ ফিরত না। নিজের হেলিকপ্টার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রোগী আনার কাজে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সরকারি আবাস হয়ে উঠেছিল দরিদ্র রোগীর আত্মীয়দের আশ্রয়। এমনকী দিল্লি গেলেও অরুণাচল ভবনে খবর নিয়ে দিল্লির হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের দেখে আসতেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি ছিলেন মাটির মানুষ। কার্যত এত দরদি ও কাজের মুখ্যমন্ত্রী আগে পায়নি রাজ্য। যে কোনও ছোটখাটো দুর্যোগেও চলে যেতেন ঘটনাস্থলে।
গত মাসে সুপ্রিম কোর্টেররায়ের জেরে ক্ষমতা হারান পুল। নাবাম টুকির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকায় তরুণ নেতা পেমা খান্ডুকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব। পুলের আশা ছিল, বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসি বিধায়করা তাঁর সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু অরুণাচল রাজনীতির কায়দা মেনে শিবির পাল্টে ফেলেন ওই বিধায়করা। পুলকে গুয়াহাটিতে একা ফেলে দিল্লি গিয়ে ফের কংগ্রেস শিবিরে যোগ দেন তাঁরা। হতাশ পুল রাজ্যবাসীর স্বার্থে সব মেনে নেন। ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, তার পর থেকেই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন আবেগপ্রবণ মানুষটি।
অরুণাচল প্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাওনা মেইনের বাড়িতে ভাঙচুর জনতার।
মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।
আজ মুখ্যমন্ত্রী আবাস ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল পুলের। বাড়িতে কেউ ছিলেন না। সকালে দেখা যায় শোওয়ার ঘরের পাখার সঙ্গে পর্দার দড়ি গলায় বাঁধা পুলের দেহ ঝুলছে। প্রাথমিক ভাবে এটিকে আত্মহত্যার ঘটনাই বলছে পুলিশ।
ঘটনা জানাজানি হতেই গণবিক্ষোভ শুরু হয় অরুণাচলে। কোনও দল বা সংগঠনের ডাকে নয়, প্রিয় নেতার মৃত্যুতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পথে নামেন মানুষ। গুজব রটে যায় রাজ্য সরকার পুলের জন্য নিম্নমানের কফিন এনেছে। সেই কফিন পুড়িয়ে দেয় জনতা। পুলিশকে পুলের দেহও মুখ্যমন্ত্রীর আবাস থেকে বের করে আনতে দিতে চায়নি জনতা। প্রিয় নেতার অন্ত্যেষ্টি মুখ্যমন্ত্রীর আবাসেই করার দাবি জানান মানুষ। পুলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কংগ্রেসে ফেরা চাওনা মেইন ও তাপাং তালো বর্তমানে স্বরাষ্ট্র ও শিল্পমন্ত্রী। তাঁদের বাড়ি ভাঙচুর করে জনতা। ইটানগরে জারি হয় কার্ফু। পরে বিরাট নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
বিক্ষোভের সময়ে জনতাদাবি করে, মৃত্যুর আগে ডায়রিতে অনেক কিছু লিখেছেন পুল।সেখানে থাকা সব নাম প্রকাশ করতে হবে। পুলের ঘনিষ্ঠ সূত্রেও দাবি করা হয়, তাঁর ঘরে একটি ডায়রিতে মৃত্যুর আগের অনেক লেখা ছিল। তা সরিয়ে ফেলেছে পুলিশ। ডিজিপি এস নিত্যানন্দন পরে জানান, ‘‘পুল একটি বিরাট লেখা রেখে গিয়েছেন। তা ঠিক সুইসাইড নোট নয়। আমরা ওই লেখা এবং অন্য তথ্য-প্রমাণ ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি।’’ পুলের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু বলেন, “এই ঘটনা আমার কাছে ব্যাপক ধাক্কা। রাজ্যের ইতিহাসে এত দয়ালু, দক্ষ নেতা কমই এসেছেন। রাজ্য পূর্ণ মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য করবে। আগামী তিন দিন রাজ্যে শোকদিবস থাকবে।”