পটনায় জেডিইউ-র দফতরের বাইরে নীতীশ কুমার এবং বাঘের ছবি সম্বলিত পোস্টারের উপরে বহুশ্রুত একটি লাইন লেখা ছিল— ‘টাইগার অভি জিন্দা হ্যায়’!
শুক্রবার বেলা গড়াতে সে লাইনের তাৎপর্য বোঝা গেল। ৭৪ বছর বয়সি নীতীশ কুমার বুঝিয়ে দিলেন, এখনও বিহারের রাজনীতির অন্যতম ভরকেন্দ্র তিনিই।
শুক্রবার সন্ধ্যায় পর্যন্ত জয় বা এগিয়ে থাকার নিরিখে এনডিএ-র ঝুলিতে ২০৭টি আসন, যা সরকার গঠনের জন্য দরকারি সংখ্যা (১২২)-র চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যে নীতীশের দল জেডিইউ পেয়েছে ৮৪টি আসন। বিজেপি ৯৪টি। জোটের বৃহত্তম শরিক না-হলেও আসনসংখ্যার নিরিখে কার্যত বিজেপির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে নীতীশের দল। অথচ পাঁচ বছর আগে ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ১১৫টিতে লড়ে মাত্র ৪৩টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল নীতীশকে। তুলনায় কম আসনে (১১০) লড়ে ভাল ফল করেছিল শরিক বিজেপি। তারা পেয়েছিল ৭৪টি আসন। সে দিক থেকে দেখলে এ বারের ভোটে নীতীশ শুধু নিজের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখলেন, তা-ই নয়, নিজের দলকেও সম্মানজনক জায়গায় তুলে আনলেন।
ভোটের আগে নীতীশের অসুস্থতা নিয়ে নানা খবর ছড়িয়েছিল। বার্ধক্যজনিত কারণে নীতীশ আর সক্রিয় রাজনীতিতে থাকবেন কি না, সেই প্রশ্নও বিহারের হাওয়ায় ভাসছিল। প্রশ্ন যে শুধু বিরোধী আরজেডি বা কংগ্রেসই তুলেছিল, তা নয়। এনডিএ-র অন্দরেও বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়। নীতীশ অবশ্য গত কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনের মতো এ বারও ভোটারদের সামনে নিজের ‘সুশাসনবাবু’ ভাবমূর্তি তুলে ধরেছিলেন। শুধু তাতেই নিশ্চিন্ত না-থেকে ভোটের আগে একের পর এক জনমোহিনী প্রকল্পও চালু করেছিলেন। প্রতিটি পরিবারকে ১২৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিনামূল্যে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নীতীশের নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। বয়স্ক নাগরিক, বিধবা মহিলা এবং বিশেষ ভাবে সক্ষম নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা পেনশনের পরিমাণ ৪০০ থেকে বাড়িয়ে ১,১০০ টাকা করে দেন নীতীশ। মহিলা ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখে ভোটের কয়েক মাস আগে ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’ চালু করে নীতীশের সরকার। এই প্রকল্পে বিহারে প্রথম দফার ভোটের কিছু দিন আগেই দেড় কোটি মহিলা উপভোক্তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা করে ঢুকেছিল।
মাঝের কয়েক মাস বাদ দিলে ২০০৫ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত পটনার কুর্সি নীতীশের হাতেই থেকেছে। ২০ বছরে বহু রাজনৈতিক অদলবদল ঘটেছে, একাধিক বার জোট বদলে ভিন্ন ভিন্ন দল বা জোটের হাত ধরেছেন নীতীশ। তার জন্য তাঁকে ‘পল্টুরাম’ বা ‘পল্টুচাচা’ বলেও বিদ্রুপ করা হয়েছে। তবে তাতে নীতীশের রাজনৈতিক গুরুত্ব কমেনি। সম্ভবত সেই গুরুত্বের কারণেই ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে নীতীশ যখন ফের আরজেডি-সঙ্গ ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলালেন, তখন তুলনায় কম আসন থাকলেও জোটের মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল নীতীশকেই। তার কয়েক মাস পরেই লোকসভা নির্বাচনে ১২টি আসনে জিতে কেন্দ্রের শাসকজোট এনডিএ-র সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সহায় হন নীতীশ। পটনার পর দিল্লিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নীতীশের দল জেডিইউ। তবে এ হেন নীতীশকেও ভোটের আগে এনডিএ-র মুখ্যমন্ত্রী ‘মুখ’ হিসাবে ঘোষণা করেননি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। বরং বলা হয়েছিল ফলঘোষণার পর বিধায়কেরাই পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীকে বেছে নেবেন। তবে প্রচারের শেষ পর্বে জল্পনায় জল ঢেলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, “নীতীশের নেতৃত্বেই এনডিএ বিহারে জয়ের নজির গড়বে।”
আরও পড়ুন:
ফলাফল বলছে, নীতীশকে বাদ দিয়ে এনডিএ-র অন্য শরিকদের নিয়ে বিহারে সরকার গঠনের অবস্থায় রয়েছে বিজেপি। তবে দিল্লিতে এনডিএ সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষায় যে দলগুলি সহায়ক, নীতীশের জেডিইউ তাদের অন্যতম। সেই সব অঙ্ক মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নীতীশের নাম ঘোষণা করে দিতে পারে পদ্মশিবির। নইলে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করতে বিলম্ব হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিহারের শাসকজোটের দুই প্রধান দল দর কষাকষির পথে হাঁটে কি না, সে দিকেই এখন নজর দেশের।
তবে সবমিলিয়ে নীতীশ ‘সুবিধাজনক’ অবস্থাতেই রয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, আরজেডি আমলের ‘জঙ্গলরাজ’-এর বিপরীতে নীতীশের ‘স্বচ্ছ ভাবমূর্তি’ বরাবরই এনডিএ-র বড় অস্ত্র। তার উপর বিহারে মদ নিষিদ্ধ করার পর মহিলা ভোটারদের মধ্যে নীতীশের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাও অস্বীকার করা মুশকিল। এই জনপ্রিয়তাকে টেক্কা দেওয়ার মতো ‘বিহারি মুখ’ বিজেপির কাছে নেই। সেই অঙ্ক মাথায় রেখেই হয়তো খানিক নিশ্চিন্ত জেডিইউ-ও।
সেই নিশ্চিন্ততা থেকেই শুক্রবার দুপুরে ভোটের ফল স্পষ্ট হতে জেডিইউ-র সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছিল, ‘নীতীশ কুমারই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন’। কিছু ক্ষণ পরেই অবশ্য পোস্টটি মুছে ফেলা হয়। তবে পোস্ট মুছলেও বিহারের ভোটে নীতীশ মোছেননি। টাইগার ‘জিন্দা’ই আছে।