ডিসটোপিয়া বা বিভীষিকাময় ভবিষ্যতের ছবিটা কী হতে চলেছে? রবিবার সন্ধ্যায় আইআইএম কলকাতার অনুষ্ঠানে আমেরিকা থেকে ভার্চুয়াল বক্তৃতায় কাঁটাছেঁড়া করছিলেন ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী। “ডিসটোপিয়া মনে হয় আর অনাগত নয়”, বলে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরলেন তিনি। তাতে জানা যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনে বানভাসি এলাকায় বিষ নোনা কোমরজলে থাকতে থাকতে প্রজনন অঙ্গে গুরুতর সংক্রমণে ভুগছেন মেয়েরা। বাধ্য হয়ে অনেককেই হিস্টেরেক্টোমি অস্ত্রোপচারে গর্ভাশয়টিও খোয়াতে হচ্ছে। দীপেশের কথায়, “এই আবহাওয়া বা বায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে হিস্টেরেক্টোমির যোগ কে দুঃস্বপ্নে কল্পনা করেছিল! একে ডিসটোপিয়া বলব না তো কী!”
দেশের প্রাচীনতম ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইআইএম কলকাতার ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর অধ্যাপক দীপেশের বক্তৃতার উপজীব্য, ‘বিজনেস এডুকেশন ইন দ্য অ্যানথ্রোপোসিন: সাম কোয়েশ্চেনস অব ইয়োর টাইম’! তাতে অ্যানথ্রোপোসিন বা মানুষের স্মরণযোগ্য প্রত্নসময়ে বায়ু পরিবর্তনের ভূমিকার কথা বলার ছিল। তবে প্রাসঙ্গিকতার দাবি মেনে প্রধানত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাল থেকে সমসময়ের কথাই উঠে আসে।
সুন্দরবনের মেয়েদের সঙ্কট প্রসঙ্গ থেকেই এ দিন উঠে এসেছে গাঁধী বা রবীন্দ্রনাথের কথা। গাঁধীর উপভোক্তা নীতি বা রাজনৈতিক মতাদর্শ আজকের ভারতে তত গ্রহণযোগ্য নয় বলে প্রশ্নোত্তর পর্বে এক অধ্যাপকের কথার পিঠেই দীপেশ ব্যাখ্যা করেন গাঁধী বা রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব। সুন্দরবনের মেয়েদের উদাহরণটি তুলে ধরে তিনি বলেন, “গাঁধী কিন্তু সব সময় দরিদ্রতমদের সঙ্গে নিয়ে চলতে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিতায় দুয়ারে দাঁড়ানো কাঙালিনী মেয়েটিকে বাদ দিয়ে পুজোর উৎসব অসম্পূর্ণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। নেহরুও নানা সরকারি প্রকল্প দরিদ্রতমদের বোঝাতে আগ্রহী ছিলেন।” টি-২০ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পাকিস্তানের হারে উচ্ছ্বসিত এক পরিচিতের পাঠানো মিমে ক্যাঙারু ও শুয়োরের অভব্য ছবির উল্লেখ করেও দীপেশ বলেন, “এই ধরনের আগ্রাসী বিদ্বেষপূর্ণ দেশপ্রেম নয়, গাঁধী, রবীন্দ্রনাথের ভারতকেই দুনিয়ার দরকার।”
অনুষ্ঠানে এ দিন বিশিষ্ট প্রাক্তনী শিরোপায় ভূষিত হয়েছেন চার জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কর্পোরেট কর্তা তথা শিল্প নির্মাতা সুনীলকুমার অলগ, বল্লভ সম্বমূর্তি, শ্রীনাথ নরসিংহ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কে সুব্রহ্মণ্যন।
সব শেষে দীপেশ প্রকৃতি, পরিবেশকে অবহেলায় মানবসভ্যতার সার্বিক সঙ্কটের কথা পাড়লেন। দীপেশ বলেন, “বিংশ শতক ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষার সময়। লিঙ্গসাম্য থেকে মানবাধিকারের নানা চেতনা ডানা মেললেও পণ্ডিতবর্গ প্রকৃতি, পরিবেশ নিয়ে প্রায় নীরব। একুশ শতক এবং সাম্প্রতিক অতিমারি মানুষকে নিজের বাঁচার স্বার্থেই অন্য কিছু শেখাচ্ছে। সবাইকে নিয়ে চলতে বলছে।”
তবে দীপেশের মতে, “অতিমারিতে বাধ্য হয়ে সরে গিয়ে মানুষ দেখেছিল, আকাশ, বাতাস আরও নির্মল, পাখিরা বা অদেখা কত প্রাণী ফিরে আসছে। যদি এখন শুধু ভাবি, কী ভাবে আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যাব, বুঝতে হবে অতিমারি থেকে কোনও শিক্ষা আমরা নিইনি!”