যে দিন থেকে আনন্দবাজার ডট কম-এ ধারাবাহিক ভাবে ‘সেনাপতির কলমে’ লিখছি, সে দিন থেকেই ধারাবাহিক ভাবে বলে আসছিলাম, ভারত প্রত্যাঘাত করবে এবং এমন প্রত্যাঘাত করবে, যা আগে কখনও ঘটেনি! মঙ্গলবার রাতে সেটাই ঘটল।
গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানা হয়েছিল। আমি ২৫ এপ্রিল আনন্দবাজার ডট কম-এ লিখেছিলাম, এ বার এমন অনেক কিছু হবে, যা এর আগে হয়নি। তার পর ২৮ এপ্রিল আবার লিখেছিলাম, পহেলগাঁওয়ে নিরীহ, নিরস্ত্র নাগরিক তথা পর্যটকদের খুন করা হয়েছে। এর জবাব যে মাত্রায় দেওয়া দরকার, সেই মাত্রাতেই দেওয়া হবে। আনন্দবাজার ডট কম-এ আমার ধারাবাহিক লেখা প্রকাশের পরেও অনেকে আমার কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছিলেন না। অনেকে হতাশও হচ্ছিলেন। অনেকের মনে হচ্ছিল, অযথা দেরি হচ্ছে, পরিস্থিতি থিতিয়ে যাচ্ছে। এর পরে ভারত আর কিছু করতে পারবে না। কিন্তু কী জানেন? সশস্ত্র বাহিনী কী ভাবে কাজ করে, বড় অভিযান কী ভাবে চালাতে হয়, একটা নিখুঁত অভিযানের জন্য কত রকমের এবং কত দিনের প্রস্তুতি দরকার হয়, সাধারণ নাগরিকের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। তাই মন্তব্য না করে সেনাবাহিনীর সদিচ্ছা এবং দক্ষতার উপর নিশ্চিন্তে ভরসা রাখা উচিত। মনে রাখতে হবে, ভারতের সামরিক বাহিনী পৃথিবীর সেরা বাহিনীগুলির অন্যতম। তার উপরে বিশ্বাস হারানোর কোনও কারণ নেই।
মনে করে দেখুন, ভারত সরকারও বলেছিল, এই সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাব ভারত দেবে। কিন্তু কখন, কোথায়, কী ভাবে দেবে, তা ভারতই স্থির করবে। ভারতই স্থির করল। কোথায় আঘাত হানা হবে, কখন আঘাত হানা হবে এবং কী ভাবে আঘাত হানা হবে, সে বিষয়ে আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও কেউ কিছু টের পাননি। মধ্যরাতে বেনজির প্রত্যাঘাত হানল ভারত। আনন্দবাজার ডট কম-এ আমার ‘সেনারতির কলমে’ সিরিজ়ে এই কথাটাও গত ২৮ এপ্রিল লিখেছিলাম। ২০১৬ সালে উরিতে জঙ্গি হামলার পরে ভারত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করেছিল। ২০১৯ সালে পুলওয়ামার ঘটনার পরে ঘটেছিল ‘এয়ার স্ট্রাইক’। এ বার আরও বড় কিছু ঘটতে চলেছে বলে লিখেছিলাম। ঠিক তা-ই হল। পাক-অধিকৃত কাশ্মীরেই শুধু নয়, পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড পঞ্জাবেও আঘাত হানল ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র।
অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন সিঁদুর’। ভারতীয়দের কাছে সিঁদুরের গুরুত্ব কেমন, তা আমার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। সে কথা সাধারণ নাগরিকও জানেন। পহেলগাঁওয়ে ২২ এপ্রিল সেই সিঁদুরই জঙ্গিদের নিশানায় পরিণত হয়েছিল। মহিলাদের মাথার সিঁদুর দেখে তাঁদের ধর্ম চিহ্নিত করা হয়েছিল। তার পরে তাঁদের স্বামীদের গুলি করে মারা হয়েছিল। মঙ্গলবার মধ্যরাতে পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের ভারত ‘সিঁদুরের দাম’ বুঝিয়ে দিল।
মনে পড়ছে সেই মহিলার কথা, যিনি বৈসরন উপত্যকায় কান্নায় ভেঙে পড়ে জানাচ্ছিলেন, কী ভাবে তাঁর স্বামীকে গুলি করে দিয়ে জঙ্গিরা বলেছিল, যাও, মোদীকে গিয়ে বলো! ভারতীয়রা সেই মহিলার হাহাকার ভোলেননি। কিন্তু পাকিস্তানিদেরও বুধবার সকাল থেকে আবার তাঁর মুখটা মনে পড়ল, যখন ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর দুই মহিলা আধিকারিক বাহিনীর তরফে থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রত্যাঘাতের বিশদ বিবরণ দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বার বার আমাদের দেশের ‘নারীশক্তি’র কথা বলেন। কর্নেল সোফিয়া কুরেশি এবং উইং কম্যান্ডার ব্যোমিকা সিংহ বুধবার সকালে ভারতের সেই নারীশক্তির ‘মুখ’ হয়ে এলেন। বৈসরণ উপত্যকায় কিছু ভারতীয় পুরুষকে হত্যা করে কিছু ভারতীয় নারীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে দেওয়া গিয়েছে বলে যাদের মনে হয়েছিল, তারা ভারতীয় নারীর কঠোর মুখমণ্ডল বুধবার দেখে নিলেন।
এবার মোট ন’টি জায়গায় ভারত আঘাত হেনেছে। এত দিন পাকিস্তানি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ভারত আঘাত হানত পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মাটিতে। এ বার জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে পাকিস্তানের পঞ্জাবের বিভিন্ন এলাকাতেও ভারত আঘাত হেনেছে। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। এই প্রথম বার এমন ঘটনা ভারত ঘটাল। পাকিস্তানের আশ্রয়ে থেকে যে সব জঙ্গি সংগঠন ভারতে নাশকতা চালানোর ছক কষতে থাকে, তাদের সদর দফতর এবং অন্যান্য পরিকাঠামো লক্ষ্য করে আঘাত হানা হয়েছে। পঞ্জাবের মুরিদকেতে লশকর-এ-ত্যায়বার সদর দফতর বিধ্বস্ত। পঞ্জাবেরই বহাওয়ালপুরে জইশ-ই-মহম্মদের সদর দফতর বিধ্বস্ত। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে গুঁড়িয়ে গিয়েছে হিজবুল মুজাহিদিনের শিবিরও।
এই অভিযান চালানোর জন্য ভারত কিন্তু পাকিস্তানের ভিতরে ঢোকেনি। ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভারতীয় আকাশসীমার মধ্যে উড়তে উড়তেই পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা এবং পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন জঙ্গি পরিকাঠামোকে নিশানা করেছে। এর থেকেই স্পষ্ট যে, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘স্ট্যান্ড অফ ওয়েপন’ (যে অস্ত্র যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করে দূর থেকে আঘাত করা যায়। লক্ষ্যবস্তুর উপরে বিমান উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে আঘাত হানতে হয় না) ব্যবহার করেই জঙ্গিদের ন’টি ঠিকানা ভারত গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
কোন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, কোন ‘স্ট্যান্ড অফ ওয়েপন’ দিয়ে আঘাত হানা হয়েছে, সে সব বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে নানা বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেনাবাহিনী সে সব তথ্য বিশদে এখনও প্রকাশ করেনি। কেউ বলছেন, রাফাল যুদ্ধবিমান থেকে ‘স্ক্যাল্প’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ‘হ্যামার’ বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। কারও দাবি, সুখোই-৩০এমকেআই যুদ্ধবিমান থেকে ‘ব্রহ্মস’ ছোড়া হয়েছে। ‘স্ক্যাল্প’ এবং ‘ব্রহ্মস’— দু’টিই ‘ক্রুজ’ ক্ষেপণাস্ত্র। ‘স্ক্যাল্প’ তৈরি হয়েছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের যৌথ উদ্যোগে। আর ভারত-রুশ যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ‘ব্রহ্মস’। প্রথমটির পাল্লা ৫৫০ কিলোমিটার। আর ‘ব্রহ্মস’ যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া হলে তার পাল্লা ৫০০ কিলোমিটার। স্থলভূমি থেকে বা জাহাজ থেকে ছোড়া হলে পাল্লা প্রায় ৯০০ কিলোমিটার। পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত আঘাত হেনেছে ভারত। যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া হলে ‘স্ক্যাল্প’ এবং ‘ব্রহ্মস’, দুই ক্ষেপণাস্ত্রই সে কাজে সক্ষম। তবে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, আরব সাগর থেকে ভারতীয় নৌসেনাও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে ‘ব্রহ্মস’ ছুড়ে আঘাত হানা কঠিন। কারণ, পাকিস্তানের মানচিত্রে ভারত যে সব জায়গায় আঘাত হেনেছে, তার দক্ষিণতম বিন্দু বহাওয়ালপুর। আরব সাগরে পাকিস্তানের জলসীমার বাইরে থেকে কোনও ভারতীয় রণতরী বা ডুবোজাহাজ যদি ‘ব্রহ্মস’ নিক্ষেপ করে, তা হলে বহাওয়ালপুর পর্যন্ত তা পৌঁছোবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তার উত্তর দিকে যে সব জায়গায় ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়েছে, সেগুলি সমুদ্র থেকে ছোড়া ‘ব্রহ্মস’ ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার আরও বাইরে হবে।
যুদ্ধজাহাজ বা ডুবোজাহাজ থেকে নিক্ষেপ করার জন্য ভারতীয় নৌসেনার হাতে অবশ্য ‘সাগরিকা’ এবং ‘কে-৪’ ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে। সাগরিকার সর্বোচ্চ পাল্লা ৭৫০ কিলোমিটার। কিন্তু কে-৪ আঘাত হানতে পারে ৩,৫০০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতেও। তাই আঘাত ঠিক কোন ক্ষেপণাস্ত্র বা কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে হানা হয়েছে, তা নিয়ে নানা চর্চা চলছে। কিন্তু যে ক্ষেপণাস্ত্রই হানা দিক, তাকে যে পাকিস্তানের এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা আটকাতে পারেনি, সে কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
পাকিস্তানকে ভারত আরও একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ভারত যুদ্ধ চায় না, সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করতে চায়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কোনও পরিকাঠামোয় ভারত আঘাত হানেনি। প্রত্যেকটি আঘাত হয়েছে জঙ্গি পরিকাঠামো লক্ষ্য করে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফ থেকে যে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতেও এ কথা স্পষ্ট ভাবে লেখা ছিল যে, পাকিস্তানের সামরিক পরিকাঠামোকে ভারত লক্ষ্যবস্তু বানায়নি। ভারতের এই বিবৃতি পাকিস্তানকে আরও চাপে ফেলেছে। এর পরে পাক সেনার পক্ষে সরাসরি ভারতীয় সামরিক পরিকাঠামোয় আঘাত হানার চেষ্টা হলে বিশ্ব জুড়ে নিন্দা শুরু হতে পারে। পাকিস্তান আরও একঘরে হতে পারে। ভারতীয় সেনা পাকিস্তানে জঙ্গি পরিকাঠামো ভেঙে দেওয়ার পরে পাকিস্তান যদি ভারতীয় সেনাকে আক্রমণ করে, তা হলে আবার প্রমাণ হবে, পাকিস্তান প্রত্যক্ষ ভাবে জঙ্গিদের পাশে। ফলে ভারত সরাসরি পাকিস্তানের সামরিক পরিকাঠামোয় আঘাত হানার নৈতিক অধিকার পেয়ে যাবে। শুধু সেখানেই ভারত থামবে না। পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ভাবেও ভারত আরও কোণঠাসা করবে, যে কথা এখনও নয়াদিল্লি স্পষ্ট করে বলেনি।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির অনেক বড় বড় কথা বলে রেখেছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের উপরেও জনমতের চাপ সম্ভবত বাড়ছে। ভারতকে আবার আঘাত করার চেষ্টা তাঁদের হয়তো করতেই হবে। কিন্তু তাতে সামরিক ভাবে শুধু নয়, অর্থনৈতিক ভাবেও পাকিস্তানের পর্যুদস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। আসলে ভারত পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে, হাতে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে যে দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার যুদ্ধ করা সাজে না!
(লেখক দেশের প্রাক্তন উপ-সেনাপ্রধান। ২০১৪-’১৫ সালে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর ১৫ কোরের কমান্ডার ছিলেন। নিবন্ধটি তাঁর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)