দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। বৈসরন উপত্যকায় যারা দুঃস্বপ্নের দুপুর নামিয়েছিল, তাদের এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারা ঘটনা ঘটিয়েছে, এনআইএ জানতে পেরেছে। কারা নানা ভাবে সাহায্য করেছে, তা-ও এনআইএ জানতে পেরেছে। কত দিন ধরে, কোন উপায়ে, কোন পথ ধরে, কত অস্ত্র আনা হয়েছিল, সেই ব্যাপারটাও এখন জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছে পরিষ্কার। সে সব তথ্যের অনেকটা জনসমক্ষে প্রকাশও করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এখন এ সব তথ্য সামনে এনে আর কী হবে? সব তথ্য বিশদ জানতে পারার পরেও যে হামলাকারীদের কাউকে এখনও ধরা যায়নি, সে কথা তো অস্বীকার করা যাচ্ছে না! তাই ঘটনা কী ভাবে ঘটল, তা আর কেউ জানতে আগ্রহী নন। এনআইএ-র কাছ থেকে কারণ জানতে কেউ চাইছেন না, তাঁরা এখন ফলাফল চাইছেন। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, তদন্ত এ বার খুব জটিল হয়ে উঠেছে। এনআইএ যে তথ্য খুঁজে বার করেছে, তা খুব সহজেই খুঁজে বার করা গিয়েছে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।
জঙ্গিদের নাম-ধাম, এমনকি, তাদের ছবিও প্রকাশ করা গিয়েছে। কিন্তু তাদের এখনও সশরীরে খুঁজে বার করা যায়নি। এর কারণ, হামলা চালানোর পরে তারা আর জঙ্গলে গা-ঢাকা দেয়নি। তারা জনতার মধ্যে মিশে গিয়েছে। অর্থাৎ, স্থানীয়দের একাংশের সাহায্য তারা পেয়েছে বা এখনও পাচ্ছে। সেই সাহায্য পাওয়ার সুবাদেই এত ঠান্ডা মাথায়, এত বিশদ পরিকল্পনা তৈরি করে, এমন নিখুঁত ভাবে নিজেদের জঘন্য কাজ সেরে তারা নির্বিঘ্নে গা-ঢাকা দিতে পেরেছে।
বৈসরন উপত্যকায় এই হামলা চালানোর আগে প্রচুর রাইফেল জড়ো করা হয়েছিল। সেগুলো এক দিনে জড়ো করা যায়নি। বিভিন্ন রুট ধরে বেশ কিছু দিন ধরে অস্ত্র জোগাড় করা হচ্ছিল। যে টাট্টু ঘোড়ায় চড়িয়ে পর্যটকদের বিভিন্ন দুর্গম উপত্যকায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই সব টাট্টু ঘোড়া ব্যবহার করেই রাইফেল ঢোকানো হয়েছিল পহেলগাঁওয়ে। অর্থাৎ টাট্টুওয়ালারা বা তাঁদের একাংশ এই সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে জড়িত। এই তথ্য কতটা চমকে দেওয়ার মতো, তা যাঁরা জম্মু-কাশ্মীরের জনবিন্যাস বিশদ জানেন, তাঁরা বুঝতে পারছেন। আসলে টাট্টুওয়ালারা হলেন গুজর বকরওয়াল জনজাতির লোকজন। যাঁরা শিয়া মুসলিম। আর দশকের পর দশক ধরে যারা কাশ্মীরে সন্ত্রাস চালিয়ে আসছে, তারা মূলত সুন্নি মুসলিম। শিয়ারা এত দিন কাশ্মীরে এই সব কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এ বারের ষড়যন্ত্রে তাদেরও যোগ থাকার অর্থ কী? অর্থ হল, শিয়া এবং সুন্নিদের মধ্যে যে দূরত্ব, তা কমিয়ে আনা হয়েছে কাশ্মীরে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কেউ একটা সেতুবন্ধন করেছে। এই সেতুবন্ধন যে কোনও লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বড় কোনও মাস্টারমাইন্ড জম্মু-কাশ্মীরে সক্রিয় হয়েছে বলেই ধরে নিতে হবে।
কিন্তু বড় কোনও মাস্টারমাইন্ড পাকিস্তানে বসে সক্রিয় হল, এ পারে ধুরন্ধর কোনও হ্যান্ডলার কাজ করতে শুরু করল, শিয়া-সুন্নি মিলে গিয়ে হামলার পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে গেল, অথচ আমরা কোনও আভাস পেলাম না কেন? আবার বলছি, এক দিনে বা রাতারাতি এই হামলা হয়নি। অনেক দিন ধরে প্রস্তুতি চলেছে। আমরা ঘুণাক্ষরেও তা টের পেলাম না কেন? টের পাইনি, কারণ জম্মু-কাশ্মীরের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সন্ত্রাসের মাস্টারমাইন্ডরাও তাদের কৌশল বদলেছে। জলের পাইপের যে দুর্বল স্থান আপাতদৃষ্টিতে চোখেই পড়ে না, সেখান থেকে জল চুঁইয়ে বেরোতে থাকলে তা বন্ধ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। জম্মু-কাশ্মীরেও তেমনই এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমাদের বাহিনী বা আমাদের গোয়েন্দাদের তরফে মাটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভবত খানিকটা কমে গিয়েছিল। প্রযুক্তির ব্যবহার বোধহয় মাটি থেকে আমাদের কিছুটা বিচ্ছিন্ন করেছে। নজরদারিতে ‘হিউম্যান ইন্টেলিজেন্সে’র ভূমিকা কিছু কমেছিল। সেই ফাঁক দিয়েই জল চুঁইয়ে বেরিয়েছে।
আরও পড়ুন:
২০১৪ সালের একটা ঘটনা বলি। আমি তখন কোর কমান্ডার। সে বছর জম্মু-কাশ্মীরের বিস্তীর্ণ অংশে একটা বড় বন্যা হল। আমাদের একটা সেনাচৌকি সেই বন্যায় ভেসে গেল। বানভাসি এলাকা থেকে আমরা আমাদের ইউনিটকে সরে আসতে বললাম। পুরো টিমটা বোটে চড়ে ওই এলাকা ছেড়ে চলে আসছিল। কিন্তু ঝিলমে সেই বোট উল্টে যায়। জলের তোড়ে বিদ্যুৎবাহী তারসমেত পোস্ট ঝিলমের মধ্যে উল্টে পড়েছিল। ওই তারে বেঁধে গিয়ে বোটটা উল্টে যায়। তাতে আমরা দু’জনকে হারাই। কিন্তু বাকি সবাইকে স্থানীয় ছেলেরাই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধার করেছিল।
ওই ঘটনার পরে আমি রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের ওই ইউনিটের অফিসারকে বলি, ছেলেগুলোকে ডেকে সংবর্ধনা দিতে। যারা নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে ওই ভাবে বানভাসি ঝিলমে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের জওয়ানদের উদ্ধার করল, তাদের অবশ্যই পিঠ চাপড়ে দেওয়া দরকার। দ্রুত ওদের সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বললাম। আমি নিজেও সেই অনুষ্ঠানে থাকলাম। নিজের হাতে ওদের সম্মান জানালাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। ফিরে আসার আগে অফিসারকে বলে এলাম, ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে এবং নানা ভাবে বাড়াতে।
কাশ্মীরিরা ক্রিকেটের জন্য পাগল। খুব ক্রিকেট ভালবাসে। ওই ছেলেগুলোকে আমরা ক্রিকেটের সরঞ্জাম দেওয়া শুরু করলাম। বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন করা শুরু হল। শুধু ক্রিকেট নয়, ফুটবল টুর্নামেন্টের ব্যবস্থাও হল। সারা বছর কোনও না কোনও ভাবে ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলাটাকে নিয়ম করে ফেলা হল। এর ফলে ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের আরও অনেকের সঙ্গে আমাদের এত ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল যে, এলাকার যেখানে যা ঘটুক, সব খবর আমরা পেয়ে যেতাম। এমনকি, প্রত্যেক শুক্রবার নমাজের পরে পাথর ছোড়ার যে ঘটনা ঘটত, তার খবরও আমরা আগাম পেতাম। কোন মোড়ে কোন সময়ে কত ক্ষণ ধরে পাথর ছোড়া হবে, ওরাই আমাদের বলে দিত। বলত, “স্যর, এই সময় থেকে ওই সময় পর্যন্ত অমুক মোড়ে আমরা একটু পাথর-টাথর ছুড়ব। ওই সময়টায় প্লিজ় ওদিকটায় যাবেন না।’’ আরও বলত, “কী করব স্যর। পাথর একটু ছুড়তেই হয়। জানেনই তো, রুটিরুজির ব্যাপার। ছুড়লে দু’পয়সা পাওয়া যায়।’’
একেই ‘হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স’ বলে। প্রযুক্তির ব্যবহার যতই বাড়ুক, প্রযুক্তির সাহায্যে নজরদারি বা সারা ক্ষণ যোগাযোগের মধ্যে থাকা যতই সহজ হয়ে উঠুক, মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের এখনও কোনও জুড়ি নেই। ‘গ্রাউন্ড টাচ’ বা মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা বলতে আমরা কী বোঝাতে চাই? বোঝাতে চাই সরাসরি বা সশরীরে মানুষজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার কথা। সব এলাকায় সশরীরে যাতায়াত করে সেখানকার পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখে রাখার কথা।
আগে সেগুলো বাধ্যতামূলক ছিল। কারণ, বিভিন্ন এলাকার খোঁজখবর রাখার সেটাই ছিল একমাত্র উপায়। কিন্তু এখন প্রযুক্তির সহায়তায় ঘরে বসে বা ক্যাম্পে বসেই অনেক খবরাখবর বা ছবির আদানপ্রদান হয়ে যায়। তাই সব সময় সব জায়গায় সশরীরে পৌঁছোনোর প্রয়োজন পড়ে না। সেখানেই গলদটা ঘটে গিয়েছে। আমাদের নজরদারিতে ‘হিউম্যান টাচ’ বা ‘মানবিক স্পর্শ’ কমে গিয়েছে। পহেলগাঁওয়ের আশপাশে যে এত কিছু নিঃশব্দে ঘটে যাচ্ছিল, আমরা টেরই পাইনি।
আরও পড়ুন:
একবার দক্ষিণ কাশ্মীরে কুলগাঁও থেকে কিছুটা দূরে একটা জায়গায় গিয়েছি। স্থানীয় ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার এসে জানালেন যে, তাঁর অধীনস্থ এলাকার মধ্যে পাঁচটা মসজিদ রয়েছে। প্রতি শুক্রবার মৌলবিরা সেখানে বিদ্বেষমূলক ভাষণ দেন। আমি প্রথমেই ওই অফিসারের প্রশংসা করলাম। কারণ, তাঁর অধীনস্থ এলাকার কোথায় কী ঘটছে, সে বিষয়ে তিনি অবহিত। অর্থাৎ, তাঁর নজরদারির নেটওয়ার্ক কাজ করছে। তার পরে তাঁকে বললাম, এর পরে যখনই খবর পাবেন যে, অমুক মসজিদে মৌলবি ওই রকম ভাষণ দিচ্ছেন, তখনই কিছুটা ফোর্স নিয়ে সেই মসজিদের সামনে চলে যাবেন। ভিতরে ঢুকবেন না। মৌলবিকে বাইরে ডেকে পাঠাবেন। তার পরে ওখানে দাঁড়িয়েই মৌলবির সঙ্গে ৪০-৪৫ মিনিট ধরে কথাবার্তা বলতে থাকবেন। পৃথিবীর সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু ওঁর বিদ্বেষমূলক ভাষণ নিয়ে একটি কথাও তুলবেন না। গল্প-টল্প করে ফিরে আসবেন। পরের সপ্তাহে আবার যখন ওই রকম ভাষণের কথা জানতে পারবেন, আবার একই ভাবে মসজিদের সামনে পৌঁছে যাবেন। সঙ্গে ক্যাম্প থেকে কিছু উপহার নিয়ে যাবেন। সেটা এক বস্তা চিনিও হতে পারে, অন্য কিছুও হতে পারে। মৌলবিকে সেই উপহার দেবেন। মসজিদে মাঝেমধ্যেই জমায়েত হয় বা মৌলবির সঙ্গে অনেকে দেখা করতে আসেন। তাঁদের চা খাওয়াতে চিনি লাগে। বা অন্য কোনও খাবার দিয়েও আপ্যায়ন করা যায়। সে রকম কিছু একটা ওই মৌলবিকে দিয়ে গল্প-টল্প করে ফিরে আসবেন। আবার যে দিন ওই বিদ্বেষ-বচনের খবর পাবেন, আবার যাবেন। আবার একই জিনিস করবেন।
আমার কথা শুনে কমান্ডিং অফিসার ওই ভাবেই চলতে থাকলেন। কয়েক মাস পরে ওই এলাকার লোকজন মৌলবিকেই প্রশ্ন করতে শুরু করল। সকলে বলতে শুরু করল, মৌলবি সাহেব ভাষণ দেওয়ার সময়ে আমাদের এত গরম গরম কথা বলেন। কিন্তু বাহিনী এলে নিজে তো তাদের সঙ্গে খুব অমায়িক ব্যবহার করেন! মৌলবির তো অমায়িক ব্যবহার না করে উপায় নেই। সেনাও তো মৌলবির সঙ্গে অমায়িক ব্যবহারই করছে। বিদ্বেষ-ভাষণের দোকান কয়েক মাসেই বন্ধ হয়ে গেল।
এতগুলো কথা লিখলাম ইন্টেলিজেন্স বা নজরদারির ক্ষেত্রে ‘হিউম্যান টাচ’ বা মানবিক স্পর্শের গুরুত্ব বোঝাতে। জম্মু-কাশ্মীরের মতো জায়গায় সেটা আরও অপরিহার্য। ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করা হয়েছে ঠিকই। জম্মু-কাশ্মীরে বহু বছর পরে নির্বিঘ্নে নির্বাচন হয়েছে এবং তাতে বহু মানুষ যোগ দিয়েছেন, সে কথাও ঠিক, কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরের মতো সংবেদনশীল জায়গায় নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও অবকাশ নেই। নিশ্ছিদ্র নজরদারি এবং স্থানীয়দের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে চলারও কোনও বিকল্প নেই।
কাশ্মীরকে যাঁরা ভাল ভাবে চিনেছেন, তাঁরা জানেন, অধিকাংশ এলাকায় বেশির ভাগ লোকই দোলাচলে রয়েছেন। পুরোপুরি জঙ্গিদের দিকেও নেই, পুরোপুরি প্রশাসনের দিকেও নেই। মাঝখানের পাঁচিলটার উপরে বসে রয়েছেন। তাঁদের বিশ্বাস যারা অর্জন করতে পারবে, তাদেরই সুবিধা হবে। যে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের নাগরিকই চাইবেন না, তাঁর এলাকা অশান্ত হোক। স্কুলের প্রিন্সিপাল হোন বা এলাকার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী— সাধারণত প্রত্যেকেই নিজের এলাকায় শান্তিই চান। আগ বাড়িয়ে জঙ্গিদের সাহায্য করে এলাকার শান্তি নষ্ট হতে দিতে অধিকাংশ লোকই চান না। এই গোত্রের নাগরিকদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রেখে যেতে হবে। কারণ, আবার বলছি, কাশ্মীরকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়ার কোনও কারণ নেই।
(লেখক দেশের প্রাক্তন উপ-সেনাপ্রধান। ২০১৪-২০১৫ সালে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর ১৫ কোরের কমান্ডার ছিলেন। নিবন্ধটি তাঁর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)