তবলায় মগ্ন মঞ্জুল।
মঞ্জুলের গবেষণা গণিতের যে শাখায়, তা হল নাম্বার থিয়োরি। স্বাভাবিক সংখ্যার বিজ্ঞান (১, ২, ৩, ৪, ৫ ইত্যাদির গড়ে ওঠা এবং নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক)। ওঁর গবেষণায় রীতিমতো সমৃদ্ধ হয়েছে ওই শাস্ত্র। বড় মাপের গণিতজ্ঞের মতো ওঁর কাজ যেন সৃজনশিল্প। তা আবিষ্কার করেছে সংখ্যার দুনিয়ায় অকল্পনীয় সুন্দর এক একটি সম্পর্ক। সংখ্যা নিয়ে আপাত সহজ, অথচ আসলে জটিল এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন মঞ্জুল।
একটি উদাহরণ: ১, ২, ৩, ... ইত্যাদি হল স্বাভাবিক সংখ্যা। এগুলির সবই কি দু’টি বর্গ সংখ্যার সমষ্টি? না, তা নয়। ১৩ (৪+৯) কিংবা ৪১ (১৬+২৫) দু’টি বর্গ সংখ্যার সমষ্টি। তবে, তিনটি বর্গ সংখ্যার সমষ্টি কি সব স্বাভাবিক সংখ্যা? তা-ও নয়। চারটি বর্গ সংখ্যার সমষ্টি কিন্তু সবই স্বাভাবিক সংখ্যা। কেননা,
০ = ০২ + ০২ + ০২ + ০২;
১ = ১২ + ০২ + ০২ + ০২;
২ = ১২ + ১২ + ০২ + ০২;
৩ = ১২ + ১২ +১২ + ০২ ইত্যাদি।
এই ধরনের একটি ধাঁধাঁর সমাধান করেছিলেন শ্রীনিবাস রামানুজন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। ওই জাতের আরও জটিল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মঞ্জুল।
গণিতে ওঁর হাতেখড়ি মা মীরা ভার্গবের কাছে। মীরা নিউ ইয়র্কে হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক। সন্তানের ছোটবেলার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন, তিন বছর বয়সী দামাল মঞ্জুলকে চুপচাপ বসিয়ে রাখতে একমাত্র টোটকা ছিল গণিত। ‘কঠিন, আরও কঠিন, অঙ্ক দাও বলে’ সব সময় বিরক্ত করত। মীরার কথায়, “কাগজ-পেনসিল নয়, ও অঙ্ক করতে ভালবাসত মনে মনে। বড় বড় সংখ্যার গুণ বা যোগ ও আঙুলের কর গুণে করে ফেলত এমন কায়দায়, যা সবাই করে না। ব্যাখ্যা চাইলে ও দিতেও পারত না। হয়তো গণিত ওর কাছে ইনট্যুইশন!” বয়স যখন আট, তখন মঞ্জুল নিজেই সমাধান করে এক ধাঁধার। কমলালেবু পিরামিডের আকারে সাজালে কোন উচ্চতার পিরামিডে কতগুলি লেবু থাকবে? সমস্যার সমাধান করতে একটা ফমুর্লা আবিষ্কার করে ফেলে মঞ্জুল। “আমার কাছে ওটা ছিল এক উত্তেজক মুহূর্ত,” বলেছেন তিনি, “গণিতের এই আগাম বলে দেওয়ার ক্ষমতা আমার বরাবর ভাল লেগেছে।”
অনেক জিনিয়াসের মতোই ছোটবেলায় স্কুলের ক্লাস ক্লান্তিকর মনে হওয়ায়, স্কুল যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল মঞ্জুল। মায়ের কাছে আবদার করেছিল তাঁর সঙ্গে কলেজে যাবে। ছেলের আবদার রেখেছিলেন মা। অঙ্কের ক্লাসে মায়ের ছোটখাটো ভুল ধরেও ফেলত স্কুলত্যাগী বালক। গণিতের পাশাপাশি সঙ্গীতেও তীব্র আকর্যণ ছেলেবেলা থেকেই। বস্তুত, সঙ্গীত না গণিত কোনটি হবে কেরিয়ার, তা নিয়ে ধন্দও ছিল কৈশোরে। শেষমেশ গণিতপ্রেমী সঙ্গীতজ্ঞ হওয়ার চেয়ে সঙ্গীতপ্রেমী গণিতজ্ঞ হওয়াই শ্রেয় জ্ঞানকরেন মঞ্জুল।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুলের পিএইচডি গাইড ছিলেন অ্যান্ড্রু ওয়াইলস, যিনি ১৯৯৫ সালে সমাধান করেছিলেন ‘ফার্মাস লাস্ট থিয়োরেম’ নামে এক ধাঁধাঁ। তার আগে সাড়ে তিনশো বছরেও কোন পণ্ডিত পারেননি ওই ধাঁধাঁর সমাধান করতে। অধ্যাপক হিসেবে প্রিন্সটনে যোগ দিয়ে প্রথম যে অসুবিধার সম্মুখীন হন মঞ্জুল, তা বিচিত্র। অনেক দিন যাঁদের স্যর বলেছেন, এ বার তাঁদের নাম ধরে সম্বোধন করতে হয়। সুদর্শন মঞ্জুলকে প্রথম দর্শনে অধ্যাপক নয়, ছাত্র বলেই ভ্রম হয়। তাঁর ছাত্রেরা মনে করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হলেও ওই অধ্যাপক তাঁদের বন্ধু বই কিছু নয়। “কিছু-মাত্র অহঙ্কার নেই ওঁর মধ্যে,” বলেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক বেনেডিক্ট গ্রস, আবার, “নেই কোনও হামবড়া ভাবও।” আর আটলান্টায় এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেন ওনো বলেছেন, “মঞ্জুলের গবেষণা বিশ্বমানের চেয়েও উঁচু। যুগান্তকারী।”
ছবি: এএফপি ও ফাইল চিত্র।