Advertisement
E-Paper

গণিতে বিশ্বসেরা জাকির-শিষ্য মঞ্জুল

অবশেষে ভারতীয় গণিতজ্ঞদের মুখে হাসি ফুটিয়ে গণিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিরোপা পেলেন মঞ্জুল ভার্গব। পেলেন ‘ফিল্ডস মেডেল’, যাকে গণিতের নোবেল প্রাইজ বলেই মনে করেন গবেষকরা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মঞ্জুল এখন আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্বদ্যালয়ের অধ্যাপক। ভারতীয়দের কাছে আরও এক সুখবর, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের কুরান্ট ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্স-এ কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ খোট পেলেন রল্ফ নেভানলিনা পুরস্কার।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৪ ০৩:২৭
বুধবার সোলে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গেইউন হাইয়ের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন মঞ্জুল ভার্গব।

বুধবার সোলে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গেইউন হাইয়ের হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন মঞ্জুল ভার্গব।

অবশেষে ভারতীয় গণিতজ্ঞদের মুখে হাসি ফুটিয়ে গণিতে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিরোপা পেলেন মঞ্জুল ভার্গব। পেলেন ‘ফিল্ডস মেডেল’, যাকে গণিতের নোবেল প্রাইজ বলেই মনে করেন গবেষকরা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মঞ্জুল এখন আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্বদ্যালয়ের অধ্যাপক।

ভারতীয়দের কাছে আরও এক সুখবর, নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের কুরান্ট ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্স-এ কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক সুভাষ খোট পেলেন রল্ফ নেভানলিনা পুরস্কার। তিনিও মঞ্জুলের মতো ভারতীয় বংশোদ্ভূত গবেষক। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল শহরে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথমেটিক্যাল কনফারেন্স শুরু হয়েছে আজ। সেখানেই পুরস্কার দু’টি তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রতি চার বছরে এক বার এই দিনেই গণিতজ্ঞদের এই বিশ্ব সম্মেলন হয়। এর আগেরটি হয়েছিল ভারতের হায়দরাবাদে। রীতি অনুযায়ী সম্মেলন উদ্বোধন করেন আয়োজনকারী দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। সেই অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পার্ক গেইউন হাই সোলে সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুরস্কার দু’টি তুলে দেন মঞ্জুল ও সুভাষের হাতে। মঞ্জুল ছাড়া ফিল্ডস মেডেল এ বার পেয়েছেন আরও তিন গণিতজ্ঞ। ফ্রান্সের আতুর আভিলা, ব্রিটেনের মার্টিন হায়েরার ও ইরানের মরিয়ম মির্জাখানি।

এই পুরস্কারের অর্থমূল্য ১৫ হাজার কানাডীয় ডলার। যেখানে নোবেল পুরস্কার ১০ লক্ষ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। তবু এই সম্মান গণিত জগতে গ্ল্যামারে সেরা। কানাডার গণিতজ্ঞ জন চার্লস ফিল্ডস এই শিরোপা চালু করেছিলেন ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান মঞ্জুল যে গণিতের এই সর্বোচ্চ শিরোপার যোগ্য এবং সেই সুবাদে ফিল্ডস মেডেল এক দিন তাঁর হাতে উঠবে, ভারতীয় গণিতজ্ঞরা তা ভাবছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরেই। এমনকী, হায়দরাবাদ সম্মেলনেই তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে, এমন আশাও করেছিলেন অনেকে। কিন্তু ২০১০ সালে মঞ্জুল পুরস্কৃত না হওয়ায় আশঙ্কায় ছিলেন ভারতীয় গণিত গবেষকেরা, কারণ বয়স ৪০ পেরিয়ে গেলে এই পুরস্কার দেওয়া হয় না। খুশির খবর এল সোল থেকে, আর সেই গবেষকরা আনন্দিত হলেন এই ভেবে যে, মঞ্জুল পেলেন জন্মদিনের যোগ্য উপহার। মাত্র গত সপ্তাহেই বয়স ৪০ হয়েছে তাঁর।

কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ সুভাষের গবেষণা যন্ত্রগণকের ক্ষমতা সম্পর্কে। কতটা কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পারে কম্পিউটার? অথবা নির্দিষ্ট একটি সমস্যার সমাধানের পথ বাতলে দিলে কত দ্রুত সেই সমাধানে পৌঁছতে পারে ওই যন্ত্র? কম্পিউটার কোন কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং পারে না, তা গণিতজ্ঞদের বহু কালের গবেষণার বিষয়। দু’টি সংখ্যার গুণফল বের করা সহজ, কিন্তু গুণফল থেকে সংখ্যা দু’টিতে পৌঁছনো কঠিন। কেন? এই রকম সব প্রশ্নের সমাধানের জন্য ঘোষিত হয়েছে মোটা অঙ্কের পুরস্কারও। কম্পিউটার বিজ্ঞানে মৌলিক গবেষণা এখন ওই সব জটিল প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে ব্যস্ত। এই রকম গবেষণায় প্রথম সারিতেই আছেন সুভাষ। গণিতের অধ্যাপক মঞ্জুল সঙ্গীতেও এক জন বিশেষজ্ঞ। বাজান সেতার, তবলা, গিটার এবং বেহালা। তবলায় জাকির হুসেনের ছাত্র মঞ্জুল কনসার্টে অংশ নিয়েছেন আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। ওঁর দাবি, সংস্কৃত শ্লোক, সঙ্গীত এবং গণিত অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। এ বিষয়ে শুধু ক্লাসে পড়ানো নয়, বক্তৃতাও দিয়ে থাকেন মঞ্জুল। ওঁর বাবা-মা জয়পুরের মানুষ, ওঁর জন্মের আগে চলে গিয়েছিলেন কানাডায়। সেখানেই মঞ্জুলের জন্ম। কিন্তু ভারতের সঙ্গে মঞ্জুলের যোগাযোগ খুবই দৃঢ়, কারণ তাঁর ছেলেবেলার অনেকটা সময় কেটেছে দাদু-ঠাকুমার কাছে জয়পুরে। সংস্কৃতের অধ্যাপক দাদুর কাছেই ওই ভাষায় হাতেখড়ি মঞ্জুলের। সেই সূত্রেই আগ্রহ জন্মায় প্রাচীন ভারতীয় গণিত সম্পর্কে। শুরু হয় গবেষণা। সাম্প্রতিক কালে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন শ্রীনিবাস রামানুজনের গণিতচর্চার সাফল্য বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে।

তবলায় মগ্ন মঞ্জুল।

মঞ্জুলের গবেষণা গণিতের যে শাখায়, তা হল নাম্বার থিয়োরি। স্বাভাবিক সংখ্যার বিজ্ঞান (১, ২, ৩, ৪, ৫ ইত্যাদির গড়ে ওঠা এবং নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক)। ওঁর গবেষণায় রীতিমতো সমৃদ্ধ হয়েছে ওই শাস্ত্র। বড় মাপের গণিতজ্ঞের মতো ওঁর কাজ যেন সৃজনশিল্প। তা আবিষ্কার করেছে সংখ্যার দুনিয়ায় অকল্পনীয় সুন্দর এক একটি সম্পর্ক। সংখ্যা নিয়ে আপাত সহজ, অথচ আসলে জটিল এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন মঞ্জুল।

একটি উদাহরণ: ১, ২, ৩, ... ইত্যাদি হল স্বাভাবিক সংখ্যা। এগুলির সবই কি দু’টি বর্গ সংখ্যার সমষ্টি? না, তা নয়। ১৩ (৪+৯) কিংবা ৪১ (১৬+২৫) দু’টি বর্গ সংখ্যার সমষ্টি। তবে, তিনটি বর্গ সংখ্যার সমষ্টি কি সব স্বাভাবিক সংখ্যা? তা-ও নয়। চারটি বর্গ সংখ্যার সমষ্টি কিন্তু সবই স্বাভাবিক সংখ্যা। কেননা,

০ = ০ + ০ + ০ + ০;

১ = ১ + ০ + ০ + ০;

২ = ১ + ১ + ০ + ০;

৩ = ১ + ১ +১ + ০ ইত্যাদি।

এই ধরনের একটি ধাঁধাঁর সমাধান করেছিলেন শ্রীনিবাস রামানুজন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। ওই জাতের আরও জটিল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন মঞ্জুল।

গণিতে ওঁর হাতেখড়ি মা মীরা ভার্গবের কাছে। মীরা নিউ ইয়র্কে হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক। সন্তানের ছোটবেলার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেছেন, তিন বছর বয়সী দামাল মঞ্জুলকে চুপচাপ বসিয়ে রাখতে একমাত্র টোটকা ছিল গণিত। ‘কঠিন, আরও কঠিন, অঙ্ক দাও বলে’ সব সময় বিরক্ত করত। মীরার কথায়, “কাগজ-পেনসিল নয়, ও অঙ্ক করতে ভালবাসত মনে মনে। বড় বড় সংখ্যার গুণ বা যোগ ও আঙুলের কর গুণে করে ফেলত এমন কায়দায়, যা সবাই করে না। ব্যাখ্যা চাইলে ও দিতেও পারত না। হয়তো গণিত ওর কাছে ইনট্যুইশন!” বয়স যখন আট, তখন মঞ্জুল নিজেই সমাধান করে এক ধাঁধার। কমলালেবু পিরামিডের আকারে সাজালে কোন উচ্চতার পিরামিডে কতগুলি লেবু থাকবে? সমস্যার সমাধান করতে একটা ফমুর্লা আবিষ্কার করে ফেলে মঞ্জুল। “আমার কাছে ওটা ছিল এক উত্তেজক মুহূর্ত,” বলেছেন তিনি, “গণিতের এই আগাম বলে দেওয়ার ক্ষমতা আমার বরাবর ভাল লেগেছে।”

অনেক জিনিয়াসের মতোই ছোটবেলায় স্কুলের ক্লাস ক্লান্তিকর মনে হওয়ায়, স্কুল যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিল মঞ্জুল। মায়ের কাছে আবদার করেছিল তাঁর সঙ্গে কলেজে যাবে। ছেলের আবদার রেখেছিলেন মা। অঙ্কের ক্লাসে মায়ের ছোটখাটো ভুল ধরেও ফেলত স্কুলত্যাগী বালক। গণিতের পাশাপাশি সঙ্গীতেও তীব্র আকর্যণ ছেলেবেলা থেকেই। বস্তুত, সঙ্গীত না গণিত কোনটি হবে কেরিয়ার, তা নিয়ে ধন্দও ছিল কৈশোরে। শেষমেশ গণিতপ্রেমী সঙ্গীতজ্ঞ হওয়ার চেয়ে সঙ্গীতপ্রেমী গণিতজ্ঞ হওয়াই শ্রেয় জ্ঞানকরেন মঞ্জুল।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুলের পিএইচডি গাইড ছিলেন অ্যান্ড্রু ওয়াইলস, যিনি ১৯৯৫ সালে সমাধান করেছিলেন ‘ফার্মাস লাস্ট থিয়োরেম’ নামে এক ধাঁধাঁ। তার আগে সাড়ে তিনশো বছরেও কোন পণ্ডিত পারেননি ওই ধাঁধাঁর সমাধান করতে। অধ্যাপক হিসেবে প্রিন্সটনে যোগ দিয়ে প্রথম যে অসুবিধার সম্মুখীন হন মঞ্জুল, তা বিচিত্র। অনেক দিন যাঁদের স্যর বলেছেন, এ বার তাঁদের নাম ধরে সম্বোধন করতে হয়। সুদর্শন মঞ্জুলকে প্রথম দর্শনে অধ্যাপক নয়, ছাত্র বলেই ভ্রম হয়। তাঁর ছাত্রেরা মনে করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন হলেও ওই অধ্যাপক তাঁদের বন্ধু বই কিছু নয়। “কিছু-মাত্র অহঙ্কার নেই ওঁর মধ্যে,” বলেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক বেনেডিক্ট গ্রস, আবার, “নেই কোনও হামবড়া ভাবও।” আর আটলান্টায় এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেন ওনো বলেছেন, “মঞ্জুলের গবেষণা বিশ্বমানের চেয়েও উঁচু। যুগান্তকারী।”

ছবি: এএফপি ও ফাইল চিত্র।

indian origin manjul bhargav top position world famous mathematics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy