Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Drama Festival

জীবন-মৃত্যুকে মজায় মিশিয়ে নাটোৎসব মাতালেন কলকি-সৌরভরা

পর পর দুই সন্ধ্যে প্রেম আর মৃত্যু, পাগলামি আর পরকীয়া, নীল আর লালের এমন তীব্র কনট্রাস্ট, তবু অন্ত্যমিলের চোরাস্রোত আর কবে দেখেছে শহর?

‘দ্য লিভিং রুম’ নাটকের দৃশ্যে সৌরভ শুক্ল ও সাদিয়া সিদ্দিকি। ছবিগুলি রাজীবাক্ষ রক্ষিতের তোলা।

‘দ্য লিভিং রুম’ নাটকের দৃশ্যে সৌরভ শুক্ল ও সাদিয়া সিদ্দিকি। ছবিগুলি রাজীবাক্ষ রক্ষিতের তোলা।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১৮:৪২
Share: Save:

পর পর দুই সন্ধ্যে প্রেম আর মৃত্যু, পাগলামি আর পরকীয়া, নীল আর লালের এমন তীব্র কনট্রাস্ট, তবু অন্ত্যমিলের চোরাস্রোত আর কবে দেখেছে শহর?

‘দ্য লিভিং রুম’— যেখানে সন্ত্রস্ত যমদূত অ্যানাকে মারতে এসে ভালবেসে ফেলছে জীবনকে।

‘টু ফর ট্যাঙ্গে, থ্রি টু জাইভ’– যে নাটকে পরকীয়া সম্পর্কে উত্তেজনা খুঁজে ফেরা পঞ্চাশোর্ধ পারমিত শেষ পর্যন্ত গোটা সমাজকেই আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন মজার ছলে।

কলকি কেকলঁ গত বছর ‘দ্য লিভিং রুম’-এর চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় হাত দিলেও এ বারে গুয়াহাটি নাট্যোৎসবের মঞ্চেই রত্নাবলী ভট্টাচার্য, জিম সার্বদের নতুন কুশীলবের দল নাটকটি প্রথম বার অভিনয় করলেন। নাটক ঘুরপাক খেয়েছে মৃত্যুকে নিয়ে। তাই মঞ্চ ও আলোয় নীল-কালো-লালের ছায়া ছিল অমোঘ। প্রথম দিকে প্রথম অভিনয়ের রেশে বার কয়েক সামান্য তাল কাটলেও দ্রুত ‘ডেথ’রূপী জিম আর যমের খেরোর খাতায় নাম তোলা অ্যানা-রূপী রত্নাবলী দ্রুত অভিনয় মুন্সিয়ানায় রাশ নিজেদের হাতে তুলে নেন। যমের সঙ্গে যমদূতের চোরপুলিশ, যমদূতের হাত থেকে নাম লেখা খাতা কেড়ে নেওয়া বা যমদূতের কুকিজে আসক্তি দর্শকের পেটে খিল ধরায়। ডেথ জানায়, আজ রাতেই মারা যাবেন অ্যানা। কিন্তু তিনি মরতে নারাজ। যমদূত ডেথের সঙ্গে অ্যানার কথোপকথনে ফিরে আসে নস্টালজিয়া। কখনও বা আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে নাতি জিমের মরণ চেয়ে বসেন অ্যানা। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার জিউসের ছদ্মবেশে যম নিজেই আসেন অ্যানার প্রাণ নিতে। তাঁর সামনেই তিন জনের মধ্যে বিস্তর টানাপড়েন চলে লাল খাতা নিয়ে। অবশেষে যমের হাতেই মৃত্যু নামে অ্যানার। শবদেহের হাত থেকে মঞ্চে গড়িয়ে পড়ে যমদূতের সাধের কুকিজ।

নাটক শেষের আলাপচারিতায় কলকি জানান, দ্য স্যান্ডম্যান ও একটি জাপানি নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তাঁর এই প্রথম উপস্থাপনা। মৃত্যু আর জীবনকে মজার মধ্য দিয়ে উপস্থাপনা করা আর মৃত্যুকে প্রেমলোভী, কুকিজপ্রেমী মানুষের চেহারায় হাজির করানো ‘দ্য লিভিং রুম’ দর্শকদের শেষ পর্যন্ত টেনে রাখে।

এ দিকে, ‘টু ফর ট্যাঙ্গে, থ্রি টু জাইভে’ রেস্তোঁরামালিক মধ্যবয়স্ক পারমিন্দর শেঠি (সৌরভ শুক্ল) ‘মিড এজ ক্রাইসিস’-এর শিকার। স্ত্রীকে ভালবাসেন খুব। কিন্তু জীবনে কিছু একটা নেই। নেই কোনও উত্তেজনা। তাই নতুন প্রেম, নতুন উত্তেজনার খোঁজে তিনি মায়ের ফাঁকা বাড়িতে ডেকে আনেন তিন মহিলাকে। প্রথম জন সোমালি সিংহ, পারমিন্দরের বন্ধু জেসির স্ত্রী। পারমিন্দর যতই রোম্যান্স চান, সোমালি (অচিন্ত কৌর) চান সেক্স। কখনও সিগারেট, কখনও হুইস্কি চাওয়া সোমালি প্রতি পদে যৌনতার আমন্ত্রণে পুরুষ সমাজ ও আদর্শ পরিবারের ধারণার মুখোশ ছিঁড়ে দেয়। শেষে তাঁকে ‘স্লাট’ বলায় সোমালি থাপ্পড় মারে পারমিন্দরের মুখে।

মুম্বইয়ের স্ট্রাগলার পঞ্জাবী মেয়ে রিংকি আবার অন্য ভাবে সমাজকে ব্যঙ্গ করে। সে নির্দ্বিধায় অপরিচিত পারমিন্দরের থেকে সিগারেট চায়, টাকা নেয়, চলে আসে তার ঘরে। শোনায় তার আগের প্রেম, দৈহিক সম্পর্ক, কাস্টিং কাউচ, শ্লীলতাহানির কাহিনি। অথচ সবটাই সোজাসাপটা মজার সুরে। সবই জানা গল্প। সংবাদপত্রে বেরোয় নিয়ম করে তেমন সব মেয়েদের কথা। কিন্তু তার পরেও রিঙ্কিরূপী সাদিয়া সিদ্দিকির প্রাণবন্ত অভিনয়, তার স্বপ্ন দর্শকদের মুগ্ধ করে। শেষে রিঙ্কির সঙ্গেও কিছুই করা হয় না পারমিন্দরের। বরং বিয়ার আর গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকা পারমিন্দরের পার্স থেকে হাজার টাকা নিয়ে চলে যায় রিঙ্কি।

তৃতীয় অঙ্কে পারমিন্দরের স্ত্রী প্রেমের প্রিয়তম বান্ধবী সবিতা (প্রীতি মামগেন) পারমিন্দরের ডাকে সাড়া দিয়ে ওই বাড়িতে আসে। কিন্তু প্রথম থেকেই সবিতার পাপবোধ, হতাশা, বিশ্বের কোনও কিছুই ভাল না ভাবা, দুঃখবিলাসী সবিতার কথার ফাঁসে জড়িতে পড়তে থাকেন পারমিন্দর। জীবন ভালবাসা পারমিন্দরকে কথার প্যাঁচে সবিতা দেখিয়ে দেন, বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র পাঁচ জন ভালমানুষের নামও করতে পারেন না তিনি। জীবনে উত্তাপ খুঁজতে আসা, প্রেম করতে চাওয়া পারমিন্দর নিজেও শেষে হতাশা ডুবতে থাকেন। সেখান থেকেই খড়কুটোর মতো জীবনে ফিরতে চান স্ত্রী প্রেমের হাত ধরে। ফোন করে স্ত্রীকে কোনও নামী রেস্তোরাঁয় খেতে ডাকেন। কিন্তু কোন রেস্তোরাঁয় যাবেন, তা নিয়ে ফের ঝগড়া শুরু। ঝগড় চলতে থাকে তাঁদের। নিভে আসে আলো।

আরও পড়ুন: শতবর্ষে পড়ে দুর্গাবাড়ির ইউএসপি আভিজাত্যই

কলকাতা এ বার নতুন সাজে আনন্দ উৎসবে

আলাপচারিতায় প্রথমেই দর্শকদের ধন্যবাদ দেন সৌরভ। শিলচরের মেয়ে তাঁর মা, তাই তিনি ছোটবেলায় অসমে এলেও এ বারের গুয়াহাটি সফর কয়েক দশক পরে। প্রীতি ও সাদিয়া প্রথম গুয়াহাটি এলেন। অচিন্ত অবশ্য তিন বছর নাগাল্যান্ডে ছিলেন। তাই এ সব এলাকা তাঁর অনেকটা চেনা।

দর্শকদের প্রশ্নের উত্তরে সৌরভ জানান, তিনি, প্রীতি, সাদিয়া, অচিন্তরা কোনও বিশেষ ব্যক্তির ছবি আঁকেননি। কিন্তু অভিনয়ের ক্ষেত্রে সৌরভের নির্দেশ ছিল, যেন সব চরিত্র খুব জীবন্ত, খুব স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সেই চেষ্টা করেছেন মাত্র। দর্শকাসন থেকে প্রশ্ন আসে, রিঙ্কির চরিত্র কি রাখি সবন্ত? সাদিয়া জানান, এক জন নয়, অনেক রাখির প্রতীক সাদিয়া। পরিচালক, চিত্রনাট্যকার সৌরভ জানান, মানুষকে বিচার করা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। কারণ নাটক শেখার হাতেখড়িতেই তিনি শিখেছিলেন, সহানুভূতি নয়, কোনও মানুষের প্রতি সমানুভূতিই মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত। তাই কেউ একদম খারাপ হয় না। কারও কাজ চোখ বন্ধ করে ‘মন্দ কাজ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। সব ভালর খারাপ থাকে। সব খারাপের পিছনেও কোনও ভাল না হতে পারার ক্ষত লুকিয়ে থাকে। পারমিন্দর আর তার তিন ক্ষণিকের সঙ্গিনীও সে ভাবেই সমাজের কোলাজ চরিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। যাওয়ার আগে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ দিয়ে যান সৌরভ, ‘‘নাটকে যা দেখলেন- তা পেশাদার অভিনেতাদের দ্বারা কৃত। দয়া করে বাড়িতে তার অনুশীলন করবেন না। বিপদ হতে পারে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE