পহেলগাম-কাণ্ডে পাকিস্তানকে মোক্ষম জবাব দিতে দেশ জুড়ে যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়ে কাশ্মীরকে গ্রাস করেছে এক অদ্ভুত স্তব্ধতা। মৃত্যুর মতো শীতল সেই নীরবতা খানখান হয়ে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাকিস্তানের ছোড়া গুলিতে, সেনার ভারী বুট আর সাঁজোয়া গাড়ির আওয়াজে। আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় সঙ্গে নিয়ে রাত কাটাচ্ছেন জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ।
এ দিকে, পূর্ব ঘোষণা মতো বুধবার রাজধানী দিল্লি-সহ দেশ জুড়ে প্রায় ৩০০টি জায়গায় আপৎকালীন মহড়া চালাবে সেনা। মূলত আকাশপথে হানা হলে কী ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভবন, শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র, সেনা ছাউনি, তৈল শোধনাগার, নদীবাঁধ, জরুরি পরিষেবা কেন্দ্রগুলিকে নিরাপদে রাখতে হবে, কী ভাবে সাইরেন বাজিয়ে মানুষকে সতর্ক করা হবে— সে সবই এ দিন বাজিয়ে দেখা হবে। প্রবীণেরা বলছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পরে এমন দেশব্যাপী সেনা মহড়া তাঁরা দেখেননি। যেমন, আজ সন্ধেয় একটি নোটিস জারি করে বায়ুসেনার তরফে জানানো হয়েছে, আগামিকাল রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ রাজস্থানে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বরাবর ব্যাপক মহড়া চালাবে বায়ুসেনা। সাড়ে ৫ ঘণ্টা ধরে তা চলবে। ওই সময়ে সীমান্তবর্তী সমস্ত বিমানবন্দরে উড়ান ওঠানামা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্য দিকে, গত কাল রাতেও জম্মু-কাশ্মীরের কুপওয়ারা, বারামুলা, পুঞ্চ, রাজৌরি, মেন্ধার, নওশেরা, সুন্দরবানি এবং আখনুর সেক্টরে গুলি চালিয়েছে পাকিস্তান। এই নিয়ে টানা ১২ দিন বিনা প্ররোচনায় সংঘর্ষবিরতি লঙ্ঘন করল তারা। সম্প্রতি দু’দেশের সেনা কমান্ডারের মধ্যে হটলাইনে এ নিয়ে কথা হলেও ইসলামাবাদ যে তা গা করেনি সেটা স্পষ্ট। সেনার তরফে জানানো হয়েছে, গুলিতেই পাল্টা জবাব দিয়েছে ভারত। কাঠুয়া এবং সাম্বা বাদে সীমান্তবর্তী কাশ্মীরের ৫ জেলাতেই কাল গুলি চলেছে।
এই গুলিযুদ্ধের আবহে সন্ত্রস্ত জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। উরির গ্রামগুলোয় বাসিন্দাদের মনে ফিরে ফিরে আসছে গোলাগুলির স্মৃতি। এখানের চুরুন্ডা গ্রামের বাসিন্দা ৬২ বছরের আবদুল কৈয়ুম বলছিলেন, ‘‘আমরা আবার খাদের কিনারে। ২০২১ সালের পর একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছিলাম। সব নষ্ট হয়ে গেল। বয়স্ক আর শিশুদের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে এই গুলির শব্দই যথেষ্ট।’’ উরির স্কুল শিক্ষিকা জ়াইনাব বানো বললেন, ‘‘সবে মাত্র গত বছর স্কুলটা পুরোদমে চালু হয়েছিল। ফের সব বন্ধ। স্কুলবাড়িটাকে আপৎকালীন বাঙ্কার হিসেবে সাজানো হচ্ছে।’’ উরির চুরুন্ডা, টিলাওয়ারি, কমলকোটে বাসিন্দাদের আপৎকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেনা জানিয়েছে, যুদ্ধ বাধলে কোন পথে পালাতে হবে, প্রাথমিক চিকিৎসা কী ভাবে করতে হবে এ সবই সীমান্তবর্তী গ্রামের বাসিন্দাদের শেখানো হচ্ছে।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, যুদ্ধ শুরু হলে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার পরিকাঠামো রাজ্যের বহু জায়গাতেই নেই। অনেকেই টিনের চালওয়ালা বাড়িতে থাকেন। গুলি কিংবা মর্টার থেকে সেগুলি সুরক্ষিত নয়। বহু জায়গা সরকারি বাঙ্কার তৈরির কাজ অর্ধসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। ফলে বিপদ এলে সাধারণ মানুষ কোথায় আশ্রয় নেবেন তা জানেন না।
গত ২৭ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের থেকে পহেলগাম কাণ্ডের তদন্তভার নেয় জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। গত কাল পহেলগাম থানার ৬ আধিকারিককে বদলি করা হয়। পহেলগামের স্টেশন হাউস কর্তা রিয়াজ় আহমেদকে সরিয়ে ওই পদে আনা হয়েছে পীর গুলজ়ারকে। সেনা সূত্রের খবর, নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ায় রবিবার রাতে এক পাক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পঞ্জাবের গুরুদাসপুর এলাকায় ঘন জঙ্গল থেকে পাকড়াও করার পরে সেনা জানতে পেরেছে, ধৃতের নাম হুসনাইন। গুজরানওয়ালার বাসিন্দা ওই ব্যক্তির থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং কিছু পাকিস্তানি টাকা মিলেছে। তবে তার পরিচয় ও এ দেশে আসার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সীমান্তবর্তী পঞ্জাবেও সক্রিয় সেনা ও পুলিশ। ওই রাজ্যের সীমান্তবর্তী একটি জঙ্গল থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার মধ্যে আইইডি, হাত-গ্রেনেড, ওয়্যারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা, রকেট গ্রেনেডও রয়েছে। পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই তাদের স্লিপার সেলকে সক্রিয় করার চেষ্টায় এই সব অস্ত্র জোগাচ্ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)