Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
general-election-2019-journalist

ভোটের স্বার্থে সেনা-বিজেপি জোট, মুম্বই চলেছে আপন ছন্দেই

‘উন্নয়নের ঝড়’ বলতে কী বোঝায়, এই মুম্বইয়ে আসা ইস্তক তা মালুম হচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই। গোটা মুম্বইয়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খোঁড়া। মেট্রো রেলের কাজ চলছে সর্বত্র। চলছে মোনো রেলের কাজ। চলছে উড়ালপুল নির্মাণ।

মুম্বইয়ের ধারাভি বস্তি।

মুম্বইয়ের ধারাভি বস্তি।

তাপস সিংহ
মুম্বই শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

সালাম বম্বে! সরকারি ভাবে নাম পাল্টে বোম্বাই যতই মুম্বই হয়ে যাক না কেন, না বলে উপায় নেই ‘সালাম বম্বে’!

ভোরের জুহু বিচ যেন এক টুকরো ভারত! আরব সাগরের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ছে বালুকাবেলায়। রোদের তীব্রতা এখনও ততটা নয়, ভারী চমৎকার হাওয়ায় শরীর-মন জুড়িয়ে যাচ্ছে একেবারে। ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একের পর এক উড়ান দৌড় শুরু করছে আরব সাগরের উপর দিয়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ নোনা বালির উপর শরীরচর্চায় ব্যস্ত। একপাশে লাফিং ক্লাবে বেশ কয়েক জন প্রবীণ-প্রবীণা হিন্দি গানের তালে তালে নানা কসরতে মগ্ন। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জীবন-দর্শনের ভিন্নতর ব্যাখ্যা মনের মধ্যে গুনগুন করে।

হাত বাড়িয়ে দেন এক বিনিয়োগকারী সংস্থার কর্ণধার বিজয়, ‘‘ওয়েলকাম টু মুম্বই।’’ কিছু বলার আগেই পাল্টা প্রশ্ন ভেসে আসে, ‘‘কী বুঝছেন? মুম্বই ছাড়া রাজ্যের অন্যান্য জায়গার কথা বলুন।’’ বিজয়ের সঙ্গেই আরও কয়েক জন আড্ডায় যোগ দেন। মুম্বইয়ের কার বাংলা এলাকায় পথশিশুদের নিয়ে কাজ করেন মীনা ভারোঠ। মীনার কথায় ভিন্ন সুর: ‘‘আমরা যে যা-ই বলি না কেন, বাইরে থেকে চটজলদি কিছু বোঝা যাবে না। আরও কয়েক দিন যাক। দেখুন না কী হয়।’’

শেষমেশ কী হবে তা না হয় বোঝা যাবে আরও কয়েক দিন পর। কিন্তু ‘উন্নয়নের ঝড়’ বলতে কী বোঝায়, এই মুম্বইয়ে আসা ইস্তক তা মালুম হচ্ছে আক্ষরিক অর্থেই। গোটা মুম্বইয়ের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খোঁড়া। মেট্রো রেলের কাজ চলছে সর্বত্র। চলছে মোনো রেলের কাজ। চলছে উড়ালপুল নির্মাণ। পদে পদে ধুলোর ঝড়! যানজটে নাজেহাল মুম্বই। আধ ঘণ্টার রাস্তা দেড় ঘণ্টায় পৌঁছবেন না দু’ঘণ্টায়, বোঝা শিবেরও অসাধ্য। তারই মধ্যে মুম্বই চলেছে নিজের ছন্দে।

চলছে মেট্রো রেলের কাজ। ফাইল চিত্র।

ছন্দপতনও কি নেই? অবশ্যই আছে। গত চার-সাড়ে চার বছর ধরে তারও সাক্ষী থেকেছে মুম্বই সমেত গোটা মহারাষ্ট্র। গত পঁচিশ বছর ধরে শিবসেনার সহযোগী বিজেপির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের নানা টানাপড়েনের পরেও কি ভাবা গিয়েছিল, এ বারের লোকসভা নির্বাচনে দু’দলের মধ্যে ফের সমঝোতা হবে? সেই প্রসঙ্গ তুললে অবশ্য অস্বস্তিতে পড়ছেন শিবসেনার নেতা-কর্মীরা। পাশাপাশি, ‘বড় দাদা’ হিস‌েবে বিজেপিকে মান্যতাও দিতে হচ্ছে বইকি।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মুম্বইয়ের চেম্বুরে নিজের দফতরে বসে যেমন বলছেন মুম্বই দক্ষিণ-মধ্য লোকসভা কেন্দ্রের বিদায়ী শিবসেনা সাংসদ রাহুল শেওয়ালে। বলছেন, ‘‘পুলওয়ামার ঘটনার পরে দেশের সব ভাবাবেগ এক হয়ে গিয়েছে। দেশের মঙ্গলের জন্যই এক হয়ে কাজ করতে হবে।’’ পাশাপাশি, এ কথাও রাহুলকে বলতে হচ্ছে, ‘‘বিজেপির সঙ্গে মতভেদ হয়েছে বটে আমাদের, কিন্তু ‘মনভেদ’ হয়নি। এখন সামনের দিকে তাকানোর সময়, পিছনের দিকে নয়।’’

আরও পড়ুন: বাংলায় মমতাদিকেই দরকার, বিজেপির চালে ছিন্দওয়াড়া দখল নিয়ে বলছেন কমলপুত্র

‘সামনের দিকে’ তাকাতে হবে বলেই মহারাষ্ট্রের মোট ৪৮টির মধ্যে আসন সমঝোতা করে বিজেপি লড়ছে ২৫টিতে এবং শিবসেনা ২৩টিতে। রাহুল শেওআলের কথারই যেন প্রতিধ্বনি শোনা গেল শিবসেনার মুখপত্র ‘সামনা’র কার্যনির্বাহী সম্পাদক ও সাংসদ সঞ্জয় রাউতের মুখে। দাদারে ‘সেনা ভবন’-এ সঞ্জয়কে প্রশ্ন করা গেল, শেষমেশ মনোমালিন্য কি মিটল? সঞ্জয়ের জবাব: ‘‘আমার মনে হয় মিটেছে। অমিত শাহ দু’বার ‘মাতশ্রী’-তে এসেছেন, কথা হয়েছে। আমাদের দু’পক্ষের মধ্যে যা যা মনোমালিন্য ছিল তা দূর হয়েছে। গত সাড়ে চার বছরে যা হয়েছে তা ভুলে যাওয়া উচিত। আমাদের পঁচিশ বছরের সম্পর্ক।’’ সঞ্জয়ের উপলব্ধি: ‘‘আলাদা আলাদা লড়লে দু’জনেরই ক্ষতি।’’

মহারাষ্ট্রে আসন সমঝোতা করেই লড়ছে বিজেপি ও শিবসেনা। ছবি পিটিআই।

অতএব, সাংবাদিক সম্মেলন করে পরস্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এবং শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে।

যদিও ভিন্ন পথে রাজনীতি করছেন বাল ঠাকরের ভাইপো রাজ ঠাকরে। তাঁর সংগঠন ‘মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা’ এ বার কোনও আসনেই প্রার্থী দেয়নি। শিবসেনা এবং বিজেপির বিরুদ্ধে তারা কট্টর অবস্থানই নিয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ দেশপাণ্ডের অভিযোগ, ‘‘বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলোকে খতম করতে চায়। আদর্শের প্রশ্নে আমরা কোনও আপোস করব না।’’ কিন্তু, ভিনরাজ্যের মানুষকে পিটিয়ে বার করে দিয়ে কোন আদর্শের কথা তাঁরা প্রচার করতে চাইছেন? সন্দীপের বক্তব্য, তাঁরা নির্দিষ্ট কোনও রাজ্যের মানুষের বিপক্ষে নন। তাঁর কথায়: ‘‘আমরা চাই, যাঁরা যে রাজ্যের বাসিন্দা তাঁরা সেই রাজ্যে চাকরি ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান। বিহারিরা তাঁদের রাজ্যে অগ্রাধিকার পান, ঠিক একই ভাবে মরাঠিরাও মহারাষ্ট্রে অগ্রাধিকার পান। আমরা জনগণকে বলছি, নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের বিরুদ্ধে ভোট দিন।’’ যদিও সন্দীপ প্রকাশ্যে যা বলছেন না তা হল, তাঁরা দলীয় কর্মীদের সভায় বলছেন, কংগ্রেস-এনসিপি জোটকে ভোট দিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করুন।’’

ব্যবসায়ী সম্প্রদায় অবশ্য মোটের উপর মোদীর পক্ষেই। তাঁরা জাতীয়তাবাদের পক্ষে বলে দাবি করছেন। যেমন, দাদারে রফতানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত চৈতন্য যোশী বলছেন, ‘‘নোটবন্দি, জিএসটি সমেত নানা কারণে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় অখুশি হলেও আমরা নরেন্দ্র মোদীকেই চাইছি। কারণ, আমরা জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক জন শক্তপোক্ত মানুষকেই চাই। আমরা মনে করি, উন্নয়নের কাজটা তাঁকে দিয়েই ভাল হবে।’’

মুম্বই ও বৃহত্তর মুম্বইয়ের ছ’টি লো‌কসভা আসনে ভোটগ্রহণ আগামী ২৯ এপ্রিল, সোমবার। ২০১৪-র লোকসভা ভোটে এই ছ’টি আসনই দখলে রেখেছিল সেনা-বিজেপি জোট। তিনটি করে আসন ভাগ করে নিয়েছিল তারা। আবার ২০০৯-এ কংগ্রেস-এনসিপি জোট ছ’টি আসনই পায়। সে বার কংগ্রেস পায় পাঁচটি, এনসিপি একটি আসন।

এ বার? ধারাভি বস্তির বাসিন্দা, পেশায় অটোচালক মহম্মদ ফিরোজ বলছিলেন, ‘‘২৩ মে-র আগে ও সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ আছে? যা হবে, ধরে নিন ‘মানুষের উন্নয়ন’-এর স্বার্থেই হবে।’’ মুচকি হেসে অটোর দিকে এগিয়ে যান ফিরোজ।

না বলে উপায় নেই, ‘সালাম বম্বে’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE