Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সত্যিই? কী করে হল! ঘুম ভাঙতেই স্তম্ভিত দেশ, ২৮ দিনের মহা-নাটকের ইতি হল কি?

অথচ শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্তও আরব সাগরে রাজনীতির ঢেউ বইছিল অন্য খাতে। মহারাষ্ট্র বিকাশ মোর্চা গঠন করে সরকার গঠন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আজই তিন দলের যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে সেই ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসা প্রায় নিশ্চিত ছিল শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের।

মহানাটক মহারাষ্ট্রে। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

মহানাটক মহারাষ্ট্রে। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৯ ১৩:৩২
Share: Save:

কোনও উপমা, কোনও ঘটনার সঙ্গেই মেলানো যাচ্ছে না। এমন মহা-কাব্যিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন কবে দেখা গিয়েছে, বা আদৌ এমন কাণ্ড কখনও ঘটেছে কি না, মনে করতে পারছেন না কেউ। সাধারণ মানুষ তো ভাবেনইনি, কল্পনায় আসেনি বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরেও। বিজেপি এবং অজিত পওয়ার ছাড়া ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পাননি। উদ্ধব ঠাকরেকে মুখ্যমন্ত্রী করে শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোটের সরকার গঠন যখন প্রায় নিশ্চিত, তখনই ভোর রাতে মহা-কাব্যের নতুন নাটকীয় পর্বটা লিখলেন দেবেন্দ্র ফডণবীশ-অজিত পওয়ার। দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন দেবেন্দ্র। এনসিপি প্রধান শরদ পওয়ারের ভাইপো অজিত পওয়ার পেলেন উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ।

অথচ শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্তও আরব সাগরে রাজনীতির ঢেউ বইছিল অন্য খাতে। মহারাষ্ট্র বিকাশ মোর্চা গঠন করে সরকার গঠন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আজই তিন দলের যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে সেই ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসা প্রায় নিশ্চিত ছিল শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের। যে কারণে মহারাষ্ট্র সংক্রান্ত খবরে আজকের সমস্ত সংবাদপত্রেও শিরোনাম সেই লাইন ধরেই। কোনও সংবাদপত্রে এই নয়া পর্বের ইঙ্গিত পর্যন্ত ছিল না।

২৪ অক্টোবর মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই ছিল পরতে পরতে নাটক। আসন সমঝোতা করে ভোটে লড়েছিল বিজেপি-শিবসেনা। কিন্তু ফল ঘোষণার পর শিবসেনা দাবি করল, আড়াই বছর করে বিজেপি এবং শিবসেনার মুখ্যমন্ত্রী করতে হবে, যা ৫০:৫০ ফর্মুলা নামেই বেশি প্রচারিত। কিন্তু বিজেপি তাতে রাজি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে তীব্র সঙ্ঘাত তৈরি হল দু’দলের মধ্যে। সেই টানাপড়েন এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদই হয়ে গেল দীর্ঘ দিনের দুই জোটসঙ্গীর মধ্যে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে শিবসেনার একমাত্র মন্ত্রীও ইস্তফা দিলেন দলের নির্দেশে। এবং শেষ পর্যন্ত এনডিএ থেকেও বেরিয়ে এল উদ্ধব ঠাকরের দল।

আরও পড়ুন:দলের সিদ্ধান্ত নয় বলছে এনসিপি, অজিতকে বিশ্বাসঘাতক বলছে শিবসেনা
আরও পড়ুন:‘কিছুই জানতাম না, এটা অজিত পওয়ারের একার সিদ্ধান্ত’, টুইট করে দাবি শরদ পওয়ারের

বিজেপি-শিবসেনার এই সঙ্ঘাত পর্বেই জল্পনায় ছিল শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোটের সম্ভাবনা। ১২ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার পর থেকেই সেই সমীকরণে গতি পেল আরও। গত ১০ দিন ধরে সেই বৈঠকের পর বৈঠক, কখনও নিজেদের মধ্যে, কখনও শিবসেনা-এনসিপির মধ্যে, কখনও কংগ্রেস-এনসিপির মধ্যে চলল আলোচনার পর আলোচনা। এমনকি, শুক্রবার রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখে আলোচনায় বসল ভিন্ন মেরুর দুই রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং শিবসেনা। সেখানে শিবসেনা মরাঠা জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্ববাদের উগ্র লাইন থেকে কিছুটা নরমপন্থী অবস্থান নিতে রাজি হল, কংগ্রেসও নরম করল অবস্থান। সেতুবন্ধন করলেন মরাঠা ‘স্ট্রংম্যান’ শরদ পওয়ার। শেষ পর্যন্ত তিন দলের সরকার গঠনের স্ক্রিপ্ট যখন চূড়ান্ত, তখনই সবার অগোচরে অন্য ইতিহাস লিখলেন দেবেন্দ্র-অজিত জুটি।

গোড়া থেকে এক বার দেখে নেওয়া যাক, কী কী নাটক লেখা হল মুম্বইয়ে। ২৪ অক্টোবর মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হল। কোনও দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। আসন বিন্যাস এই রকম—বিজেপি ১০৫, শিবসেনা ৫৬, এনসিপি ৫৪, কংগ্রেস ৪৪। ৫০:৫০ সঙ্ঘাতে সরকার গঠন করতে পারল না বিজেপি-শিবসেনা।

ফল ঘোষণার প্রায় দু’সপ্তাহ পরে ৮ নভেম্বর বৃহত্তম দল হিসেবে বিজেপিকে সরকার গঠনের আহ্বান জানালের রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারি। সময় দিলেন ৭২ ঘণ্টা অর্থাৎ তিন দিন। কিন্তু পদ্ম শিবিরে তেমন তৎপরতা প্রায় ছিল না। শিবসেনাকে আড়াই বছরের মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছাড়তে নারাজ বিজেপি কার্যত নিষ্ক্রিয়ই থাকল ওই তিন দিন। এবং শেষ পর্যন্ত সরকার গঠনের দাবিই জানাল না।

১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল শিবসেনাকে সরকার গঠনের জন্য ডাকলেন রাজ্যপাল। সময় দেওয়া হল ২৪ ঘণ্টা। চূড়ান্ত তৎপরতা শুরু হল উদ্ধব-শরদ-সনিয়া শিবিরে। বৈঠকের পর বৈঠক চলল তিন শিবিরে। এনসিপি আগে থেকেই শিবসেনার সঙ্গে জোট সায় দিয়েছিল। দিল্লিতে কংগ্রেস-এনসিপি বেশ কয়েক দফা বৈঠকের পর শিবসেনার সঙ্গে জোট গড়ে সরকার গঠনে সনিয়াকে রাজি করালেন শরদ পওয়ার। নীতিগত সায় দিলেন সনিয়া গাঁধী।

কিন্তু সেখানেও নাটক। নীতিগত সায় দিলেও কংগ্রেস বা কোনও দলই শিবসেনাকে সমর্থনপত্র দেয়নি। এ দিকে সময় শেষ হয়ে আসছে। অবশেষে সমর্থনপত্র ছাড়াই রাজভবনে ছুটলেন উদ্ধবপুত্র আদিত্য। সরকার গঠনের জন্য আরও সময় চাইল শিবসেনা। বিজেপিকে যদি ৩ দিন সময় দেওয়া হয়, তা হলে তাঁদের কেন এক দিন দেওয়া হল, এই প্রশ্ন তুলে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনল শিবসেনা।

কিন্তু সময় দিলেন না রাজ্যপাল। বরং পরের দিন, ১১ নভেম্বর, তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে সরকার গঠনের জন্য ডাকলেন এনসিপিকে। কিন্তু এত অল্প সময়ে সরকার গঠন সম্ভব নয়, ১২ নভেম্বর দুপুরের দিকেই রাজ্যপালকে জানিয়ে দিলেন এনসিপি নেতৃত্ব।

অন্তিম বিকল্প রাষ্ট্রপতি শাসন। কেন্দ্রকে সেই সুপারিশই করলেন রাজ্যপাল ভগৎ সিংহ কোশিয়ারি। ব্রাজিল সফর বিলম্বিত করে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হল, সরকার গঠনের পথ খোলা রেখে ৬ মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশপত্রে সিলমোহর দিয়ে ব্রাজিল উড়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। ৩৫৬ ধারায় সই করলেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। কার্যকরী হল রাষ্ট্রপতি শাসন।

শুরু হল নতুন অধ্যায়। শিবসেনা-এনসিপি কংগ্রেস নীতিগত ভাবে প্রায় এক ছাতার তলায় এসেই গিয়েছিল। শুধু সরকার গঠনের চূড়ান্ত রূপরেখা স্থির করতে ১২ নভেম্বরের পর থেকে তিন দলের মধ্যে কত যে বৈঠক, ফোনালাপ, দরবার, আলোচনা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

শেষ পর্যন্ত শুক্রবার তিন দল এক সূত্রে বাঁধা পড়ল এবং শনিবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার কথা জানিয়ে রাখল। কিন্তু সেই সুযোগ দিলেন না ফডণবীশ-অজিত জুটি।

এর মধ্যেই গত বুধবার, ২০ নভেম্বর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আচমকাই দেখা করেন শরদ পওয়ার। তার দু’দিন আগে, রাজ্যসভায় এনসিপি-র প্রশংসা শোনা গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর মুখে। শনিবারের ভোররাতের নাটকের নেপথ্যে সেই সবের কোনও সম্পর্ক আছে কি? প্রশ্ন উঠলেও, আপাতত উত্তর দেওয়ার কেউ নেই।

শনিবার, আরব সাগরে সূর্যোদয়ের আগেই মুম্বই পেল দ্বিতীয়বারের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীশকে। মহারাষ্ট্র থেকে ভোর ৫টা ৪৭ মিনিটে উঠে গেল রাষ্ট্রপতি শাসন। নতুন উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অজিত পওয়ারকে পেল শিবাজির রাজ্য। সব সংবাদপত্রের শিরোনাম হারিয়ে ফেলল প্রাসঙ্গিকতা। বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে পারবে কি না, এনসিপি বিধায়করা দলত্যাগ আইনে পড়বেন কিনা, শরদ পওয়ারের নেপথ্য ইঙ্গিতেই অজিত পদ্ম-পুকুরে ঝাঁপ দিলেন কিনা, সেনা-কংগ্রেস-এনসিপি জোটের ভবিষ্যৎ কি— ঘুম ভেঙেই চর্চার কেন্দ্রবিন্দু ঘুরে গেল সেই দিকে। প্রথম বারের জন্য ঠাকরে পরিবার থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ইতিহাস গড়া আপাতত হল না উদ্ধব ঠাকরের। কিন্তু ৩০ নভেম্বর সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে ফডণবীশকে। নাটক তার আগে শেষ হবে কি...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE