E-Paper

একাধিক নিয়ম না মানাই কি সিল্কিয়ারার বিপর্যয়ের জন্য দায়ী? সুড়ঙ্গকাণ্ডে উঠছে নানা প্রশ্ন

প্রথমেই যে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তা হল, দীপাবলির দিনেও শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো। বারকোট প্রান্ত থেকে সুড়ঙ্গ খননের দায়িত্বে যে সংস্থা রয়েছে, তারা সে দিন শ্রমিকদের ছুটি দিয়েছিল।

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৩ ০৬:৪১
uttarkashi tunnel collapse

উত্তরকাশীতে এই সুড়ঙ্গের একাংশ ভেঙেই বিপর্যয় ঘটেছে। —ফাইল চিত্র।

উদ্ধারপর্ব শেষ। এ বার পরবর্তী ধাপে শুরু হল ধসের কারণ খতিয়ে দেখার কাজ। চার ধামের অন্যতম যমুনোত্রী থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে সিল্কিয়ারা-বারকোট সুড়ঙ্গে হওয়া ওই ধসের কার্যকারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। শুরু হয়েছে সিল্কিয়ারার দিক থেকে সুড়ঙ্গ তৈরির দায়িত্বে থাকা সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের ডেকে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদও।

প্রথমেই যে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তা হল, দীপাবলির দিনেও শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো। বারকোট প্রান্ত থেকে সুড়ঙ্গ খননের দায়িত্বে যে সংস্থা রয়েছে, তারা সে দিন শ্রমিকদের ছুটি দিয়েছিল। কিন্তু সিল্কিয়ারা প্রান্ত থেকে সুড়ঙ্গ তৈরির দায়িত্বে থাকা সংস্থা ‘নবযুগ’ সে দিন তাদের শ্রমিকদের ছুটি দেয়নি। ছুটি থাকলে সে দিন দুর্ঘটনার মুখে পড়তে হত না শ্রমিকদের। তাই প্রশ্ন উঠেছে, কেন ছুটি দেওয়া হয়নি দীপাবলিতে? তা হলে কি দ্রুত কাজ শেষ করার চাপ ছিল সংস্থাটির উপরে?

এই সূত্রেই বার বার প্রশ্ন উঠছে, দ্রুত কাজ শেষের চাপ ছিল বলেই কি সুড়ঙ্গ খননের সময়ে ক্রমাগত অগ্রাহ্য করা হয়েছে নিরাপত্তার দিকগুলি?

যখনই এ ধরনের সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়, তখন সুড়ঙ্গের ভিতরে মাটির সমান্তরালে ‘হিউম পাইপ’ বসানোর নিয়ম রয়েছে। মূলত কংক্রিটের তৈরি ওই পাইপ যেমন সুড়ঙ্গের বিষাক্ত বাতাস বাইরে নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহার হয়, তেমনই কোনও ধস নামলে ওই পাইপে আশ্রয় নিতে পারেন শ্রমিকেরা। পরে ওই পাইপের সাহায্যেই তাঁরা বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জানা যাচ্ছে, গোড়ার দিকে সুড়ঙ্গে হিউম পাইপ ব্যবহার হলেও দীপাবলির মাত্র কিছু দিন আগে ওই পাইপ সুড়ঙ্গ থেকে বার করে আনা হয়েছিল। অনেকের মতে, পাইপটি থাকলে নিরাপদেই বেরিয়ে আসতে পারতেন শ্রমিকেরা। সচরাচর যেখানে সুড়ঙ্গ শেষ হওয়ার পরে হিউম পাইপ সরানোর কথা, সেখানে পাইপটি কেন কাজ শেষের আগেই বার করে আনা হল, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। নির্মীয়মাণ সুড়ঙ্গ ‘কেভ ইন’ করলে অর্থাৎ সুড়ঙ্গ ধসে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি হলে কী হবে, সে কথা মাথায় রেখে শ্রমিকদের বাঁচাতে সুড়ঙ্গে ‘ট্রেঞ্চ কেজ’ ব্যবহার হয়ে থাকে। ধস নামার পরিস্থিতিতে কংক্রিটের ওই খাঁচাগুলিতে শ্রমিকেরা আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, সুড়ঙ্গে কোনও ট্রেঞ্চ কেজ ছিল না। অভিযোগ,সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে শ্রমিক নিরাপত্তার দিকটি।

সিল্কিয়ারা থেকে বারকোট পর্যন্ত ওই সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য সাড়ে চার কিলোমিটারের কাছাকাছি। সাধারণত কোনও সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য দেড় কিলোমিটারের বেশি হলেই সেই সুড়ঙ্গে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বেরোনোর রাস্তা (এসকেপ প্যাসেজ) থাকার কথা। সিল্কিয়ারার সুড়ঙ্গের নকশাতে ওই প্যাসেজ দেখানো হলেও, বাস্তবে তা আদৌ ছিল না। খরচ বাঁচাতেই কি নির্মাণকর্তারা এসকেপ প্যাসেজ বানানো এড়িয়ে গিয়েছিলেন, খতিয়ে দেখা হচ্ছে তা-ও।

প্রশ্ন উঠেছে এলাকার ভূমির চরিত্র নিয়েও। এই অঞ্চল এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ। ১৯৯১ সালে রিখটার স্কেলে ৬.৮ তীব্রতার ভূমিকম্পের সাক্ষী থেকেছে উত্তরকাশী। ওই বিপর্যয়ে মারা গিয়েছিলেন অন্তত দু’হাজার মানুষ। সাধারণত টেকটনিক প্লেটের অবস্থান পরিবর্তনের কারণেই ভূমিকম্প হয়ে থাকে। গোটাপৃথিবী এ ধরনের একাধিকটেকটনিক প্লেটে বিভক্ত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতীয় প্লেট ও ইউরেশীয় প্লেটের সংযোগস্থলে যে চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে তা মোটের উপরে হিমালয় পর্বতমালার সমান্তরালে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্বে চলে গিয়েছে। এই চ্যুতিরেখার খুব কাছেই অবস্থিত সিল্কিয়ারা সুড়ঙ্গ।

প্রশ্ন হল, চ্যুতিরেখার কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও কেন ওই সুড়ঙ্গ তৈরিতে ছাড় দেওয়া হল? ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হওয়ায় ওই সুড়ঙ্গে ভূমিকম্পের প্রভাব কতটা পড়তে পারে, সে বিষয়ে সাইসমিক সমীক্ষা হয়নি বলেই সূত্র মারফত জানা গিয়েছে। কেন হয়নি, তার কোনও জবাব নেই কেন্দ্রীয় সড়ক নির্মাণ ও পরিবহণ মন্ত্রকের কর্তাদের কাছে।

আল্পস পর্বতমালার তুলনায় হিমালয় বয়সে নবীন ও চরিত্রে অশান্ত। সূত্রের মতে, বারকোট প্রান্তের তুলনায় সিল্কিয়ারা প্রান্তের পাহাড় চরিত্রগত ভাবে অনেক বেশি ভঙ্গুর। সড়ক নির্মাণ মন্ত্রকের খবর, সিল্কিয়ারা প্রান্তের ভূ-ত্বক বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছিল, সেখানে সুড়ঙ্গ বানানোর পক্ষে অনুকূল পাথর রয়েছে মাত্র কুড়ি শতাংশ। সুড়ঙ্গের অধিকাংশ এলাকায় মূলত পাললিক শিলা ও স্লেট পাথর রয়েছে, যা নরম ও ভঙ্গুর। এই চরিত্রের পাথর সুড়ঙ্গ বানানোর পক্ষে অনুকূল নয়। তা সত্ত্বেও ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল ওই সুড়ঙ্গকে। ভূ-ত্বকের বিশ্লেষণ রিপোর্ট কেন উপেক্ষা করা হয়েছিল, সেই প্রশ্ন এখন উঠছে।

বারকোট এলাকায় কর্মরত এক বাঙালি শ্রমিকের কথায়, ‘‘পাহাড়ের উপরের শক্ত অংশের পরেই কেবল মাটি রয়েছে। সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময়ে সম্ভবত ঠিক ভাবে ঠেকনা (সাপোর্ট) না দেওয়ার জন্যই পাহাড়ের মাটি-পাথর ধসের আকারে নেমে এসেছে।’’ তা ছাড়া, ওই রিপোর্টটিও কেবলমাত্র তিনটি জায়গার ভূ-ত্বকের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বানানো হয়েছিল। সাড়ে চার কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গের জন্য তা মোটেই যথেষ্ট নয় বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

অন্য একটি সূত্রের দাবি, দীপাবলির দিনে সুড়ঙ্গ খননের কাজে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। বিস্ফোরণের সময়েযে ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত, কার্যক্ষেত্রে তা ছিল না বলেই সিল্কিয়ারা প্রান্তে ধস নেমেছে— এমন সম্ভাবনাও তাই উড়িয়ে দিচ্ছেননা বিশেষজ্ঞেরা।

সব মিলিয়ে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে, একাধিক নিয়ম না মানাই হয়তো সিল্কিয়ারার বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। ওই সুড়ঙ্গের নির্মাণকাজে কী কী নিয়ম অগ্রাহ্য করা হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ (এনডিএমএ)-এর পরামর্শদাতা সৈয়দ আটা হাসনইন বলেন, ‘‘তদন্ত কমিটি কাজশুরু করেছে। দুর্ঘটনার কারণ, ভিতরে নিরাপত্তা সংক্রান্ত কী ধরনের প্রস্তুতি ছিল, এমন সব দিক খতিয়ে দেখে কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেবে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Uttarkashi Tunnel Collapse Uttarkashi Tunnel Rescue Operation

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy