Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আতঙ্কিত বরাক

উপত্যকায় ফের সক্রিয় জঙ্গিরা

দক্ষিণ হাইলাকান্দিতে ফের সক্রিয় হচ্ছে জঙ্গিরা। মিজোরাম সীমানার গ্রামগুলিতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এক দিকে বেড়েছে ‘ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক লিবারেশন আর্মি’র (উদলা) তৎপরতা। অন্য দিকে ‘বরাক ভ্যালি টাইগার ফোর্স’ নামে অন্য একটি জঙ্গি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। অপহরণ করে মাসের পর মাস অপহৃতদের আটকে রাখছে উদলা। নতুন সংগঠনটি একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তবে পুলিশের দাবি, নাশকতা রুখতে তারা সতর্ক রয়েছে।

অমিতরঞ্জন দাস
হাইলাকান্দি শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

দক্ষিণ হাইলাকান্দিতে ফের সক্রিয় হচ্ছে জঙ্গিরা। মিজোরাম সীমানার গ্রামগুলিতে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এক দিকে বেড়েছে ‘ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক লিবারেশন আর্মি’র (উদলা) তৎপরতা। অন্য দিকে ‘বরাক ভ্যালি টাইগার ফোর্স’ নামে অন্য একটি জঙ্গি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। অপহরণ করে মাসের পর মাস অপহৃতদের আটকে রাখছে উদলা। নতুন সংগঠনটি একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তবে পুলিশের দাবি, নাশকতা রুখতে তারা সতর্ক রয়েছে।

২০১৬ সালে অসমে বিধানসভার নির্বাচন। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, সে দিকে তাকিয়েই তৎপরতা বাড়িয়েছে রিয়াং জঙ্গিরা। সংগঠনকে নতুন করে সাজিয়েছে উদলা নেতা ধন্যরাম। দু’টি গোষ্ঠীতে সদস্যদের ভাগ করেছে। একটি রাইফেলমারা গোষ্ঠী, অন্যটি ঘুটঘুটি। গত ৪ জানুয়ারি আগর কাঠের ব্যবসায়ী শিবসাগরের রন্টু গগৈ ও নাজিরার বিতুল কলিতাকে অপহরণ করে উদলা। আড়াই মাসেও পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করতে পারেনি। হাইলাকান্দির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজমোহন রায় জানিয়েছেন, তল্লাশি অভিযান চলছে। ঘুটঘুটি গোষ্ঠীকে দিয়ে ধন্যরাম ওই অপহরণ করিয়েছে। ২০ মার্চ উদলার তিন ক্যাডারকে আটক করে পুলিশ। তিন জনই ঘুটঘুটি গোষ্ঠীর সদস্য। রাজমোহনবাবুর কথায়, “উদলার দু’টি গোষ্ঠীর হাতেই আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে।”

শুধু রিয়াং জঙ্গিরাই নয়, বিধানসভা নির্বাচনের মুখে পুলিশকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়ে দামছড়ায় তৈরি হয়েছে ‘বরাক ভ্যালি টাইগার ফোর্স’। তবে এরই মধ্যে পুলিশ তাদের স্বঘোষিত সেনাধ্যক্ষ-সহ কয়েক জনকে পাকড়াও করেছে। জেরায় ধৃতরা স্বীকার করেছে, ১ ফেব্রুয়ারি হাইলাকান্দিতে বোমা বিস্ফোরণের পিছনে ছিল তারাই।

১৯৯৮ সালে মিজোরাম থেকে বিতাড়িত রিয়াংদের হাত ধরে হাইলাকান্দিতে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হয়। মিজোদের সঙ্গে সংঘাতের পর ৩৫ হাজার রিয়াং প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। সেখান থেকেই তাঁরা মিজো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষোভ প্রকাশের পর আচমকা বন্দুক হাতে তুলে নেয়। আত্মপ্রকাশ করে ‘ব্রু ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা’ (বিএনএলএফটি) নামে জঙ্গি সংগঠন। ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরে সেটির সূচনা হলেও জঙ্গিরা ঘাঁটি গড়ে হাইলাকান্দি জেলার মিজোরাম সীমানা সংলগ্ন রিয়াং গ্রামগুলিতে। নন্দেশ্বর রিয়াং নামে স্থানীয় এক যুবক মদত জোগান। তাকেই হাইলাকান্দির প্রথম জঙ্গি বলে মনে করা হয়। নন্দেশ্বর হাইলাকান্দি জেলাশাসকের অফিসে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ছিল। কয়েক দিনের মধ্যে দেখা যায়, তারা মিজো সংঘাতের কথা ভুলে হাইলাকান্দি জেলাতেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ শুরু করেছে। প্রথমে দক্ষিণ হাইলাকান্দির পাহাড়ি গ্রামগুলির বাসিন্দাদের জঙ্গি-কর দেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়। পরে শুরু হয় তোলাবাজি।

পুলিশ সূত্রে খবর, ১৯৯৯ সালে গুলিতে মৃত্যু হয় নন্দেশ্বরের। সবাই ভেবেছিলেন হয়তো এ বার স্বস্তি মিলবে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই জঙ্গিদের তাণ্ডব বাড়ে। নন্দেশ্বরের জায়গা নেয় তার সতীর্থ সুধন্য রিয়াং। এই নেতৃত্ব পরিবর্তন জেলার সন্ত্রাসবাদকে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। ২০০০ সালে পঞ্চরাম রিয়াং নামে এক স্কুলশিক্ষক অন্য একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে। সেটির নাম হয় ‘ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক লিবারেশন ফ্রন্ট অব বরাকভ্যালি’ (ইউডিএলএফবিভি)। পঞ্চরামের সঙ্গে হাত মেলায় ধন্যরাম রিয়াং। ২০০১ সালে হাইলাকান্দিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তারা। বিএনএলএফটি সুবিধা করতে পারছিল না। হাইলাকান্দি থেকে তারা সরে যায়। পঞ্চরাম-ধন্যরাম তোলাবাজির সঙ্গে কয়েকটি অপহরণও করে। ধীরে ধীরে নিজেদের ‘কর্মক্ষেত্র’ করিমগঞ্জ জেলাতেও ছড়িয়ে দেয়। চেরাগি অঞ্চলে প্রায়ই হানা দেয় ইউডিএলএফবিভি। মাঝেমধ্যে ঢোকে কাছাড় জেলাতেও। সরকার তাদের প্রথমে জঙ্গি বলে মানতে রাজি না হলেও, পরে তাদের আত্মসমর্পণ করানোর জন্য ছক কষে। ২০০৮ সালে ৩০২ জন সদস্য নিয়ে পঞ্চরাম আনুষ্ঠানিক ভাবে অস্ত্র তুলে দেয় মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈর হাতে।

এক বার কোনও অঞ্চলে জঙ্গি কার্যকলাপ শুরু হলে আত্মসমর্পণের পরও যে সমাধান মেলে না, তার বড় উদাহরণ হাইলাকান্দি জেলা। পঞ্চরাম আত্মসমর্পণ করলেও ধন্যরাম আত্মগোপন করে। তৈরি হয় ‘ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক লিবারেশন আর্মি’ (উদলা)। এরাও তোলাবাজি, অপহরণে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। পুলিশ জানায়, পঞ্চাশটিরও বেশি অপহরণের ঘটনার সঙ্গে ওই সংগঠনটি জড়িত। সক্রিয় হয় পুলিশ। করিমগঞ্জে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষ হয়। কয়েক জন জঙ্গি প্রাণ হারায়। মিজোরামে ধরা পড়ে সংগঠনের মাথারা। তার জেরে কয়েক দিন পরিস্থিতি শান্ত ছিল। শিশুরামের হাতে নেতৃত্ব গেলেও সে ভাবে সংগঠন ধরে রাখা যায়নি। জামিনে মুক্তি পেয়ে ধন্যরাম কয়েক দিন চুপচাপ ছিল। কিন্তু ভোট আসতেই নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। দু’টি গোষ্ঠী তৈরি করেছে সে। সঙ্গে রয়েছে বরাক ভ্যালি টাইগার ফোর্স। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজমোহনবাবু অবশ্য বলেন, “পুলিশ সতর্ক রয়েছে। জঙ্গিরা নাশকতা ছড়ানোর সুযোগ পাবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE