দুর্গম পীরপঞ্জল পর্বতশ্রেণি ফুঁড়ে তৈরি করা দেশের দীর্ঘতম রেলপথ-সুড়ঙ্গের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, গত বছর। ভার্চুয়াল মাধ্যমে পতাকা নাড়িয়ে শ্রীনগর-উধমপুর-বারামুলা রেল প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন। বিষয়টিকে জাতীয় প্রকল্প ঘোষণা করেছিল মোদী সরকার।
সূত্রের খবর, বারামুলা প্রকল্পের অন্তর্গত প্রায় দশ কিলোমিটার দীর্ঘ টি-৪৮ সুড়ঙ্গে দুর্নীতির জল চুঁইয়ে ঢুকেছে— এমন অভিযোগে উত্তপ্ত হল সংসদের পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) বৈঠক। গত নভেম্বরেই সিএজি তার রিপোর্টে এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের প্রশ্নে বহু অনিয়মের নজির তুলে ধরেছিল। তার ভিত্তিতে গতকাল পিএসি বৈঠকে বিরোধী সাংসদরা রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং সিইও সতীশকুমারকে অবিলম্বে কারণ দর্শাতে বলেছেন বলে খবর। এ-ও জানা গিয়েছে, পিএসি-র বিজেপি সাংসদরা উচ্চবাচ্য করেননি এই নিয়ে।
সূত্রের খবর, গত বৃহস্পতিবার সিএজি-র উল্লিখিত রিপোর্টটি পিএসি বৈঠকে আলোচনার সময় কমিটির চেয়ারম্যান কে সি বেণুগোপাল-সহ বিভিন্ন বিরোধী দলের সাংসদ রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানকে একের পর এক প্রশ্ন করেন। মূল অভিযোগ, সবচেয়ে কম দরপত্র দিয়ে গ্যামন ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনট্রাক্টরস লিমিটেড সংস্থা (যা গ্যামন ইন্ডিয়ার সহোদর সংস্থা) ১১১০.৮০ কোটি টাকার বরাত জোগাড় করল কী ভাবে? পাশাপাশি এই বরাত পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের নজির তুলে ধরেছে সিএজি তার ২০২৪ সালের ৪ নং রিপোর্টে।
সিএজি-র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, গ্যামন ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনট্রাক্টরস আর্থিক ও প্রযুক্তিগত ভাবে দরপত্রে দেওয়া নির্ধারিত মানদণ্ডের ধারে কাছেও ছিল না। কারণ, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ওই সংস্থার ২০১৬-র মার্চের ব্যালেন্স শিট দাখিল করার কথা থাকলেও তারা নিজেদের কোনও ব্যালেন্স শিট না দিয়ে গ্যামন ইন্ডিয়ার ব্যালেন্স শিট কমিটিকে ধরিয়ে দেয়, যা কোনও ভাবেই বৈধ নয়। কারণ, গ্যামন ইন্ডিয়া দরপত্রে অংশই নেয়নি। এ ছাড়া অভিযোগ, দরপত্রের বিষয়ে সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশনের বিধি সরাসরি লঙ্ঘন করা হয়েছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, গ্যামন ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনট্রাক্টরস ২০১৬-১৭ সালের যে আংশিক ব্যালেন্স শিট দেয়, সেখানে দেখানো হয়েছে ২০১৫-১৬ সালে ওই কোম্পানির নগদ ব্যালেন্স ছিল মাত্র ৯ লক্ষ টাকা। ওই বছর কোনও ব্যবসায়িক লেনদেন হয়নি। এমনকি তাদের না ছিল কারখানা বা যন্ত্র।
সূত্রের বক্তব্য, এমন মৃতপ্রায়, অক্ষম, নির্ধন সংস্থাকে প্রকল্পের জন্য বিপুল টাকার বরাত দেওয়া হয়েছিল কেন তা পিএসির সদস্যরা জানতে চাইলে রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন, সব কিছু নিয়ম মেনে হয়েছে। অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল-ও অনিয়ম হয়নি বলে লিখিত মতামত দিয়েছেন। সূত্রের খবর, এরপর বৈঠক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিরোধী দলের সাংসদরা চেয়ারম্যানকে বলেন, তিনি কি বলতে চান, সাংবিধানিক সংস্থা সিএজির রিপোর্টে মিথ্যাচার করা হয়েছে? রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে বরাত পাইয়ে দেওয়ার কথাই শুধু বলা হয়নি, কারা জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে। সদস্যরা কমিটির চেয়ারম্যান বেণুগোপালের কাছে দাবি তোলেন, সিএজির সুপারিশ মতো ব্যবস্থা নেওয়ার।
বিরোধীদের মধ্যে ডিএমকে-র তিরুচি শিবা, এসপি-র ধর্মেন্দ্র যাদব, কংগ্রেসের অমর সিংহ, জয়প্রকাশ ছাড়াও তৃণমূল কংগ্রেসের সৌগত রায় ও সুখেন্দুশেখর রায় সরব হন বলে রাজনৈতিক সূত্রের খবর। এ কথাও জানা গিয়েছে, মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে কারা দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, তাঁদের পরিচয়সহ সমস্ত নথি কমিটির কাছে জমা দিতে রেল বোর্ডের সিইও সতীশ কুমারকে বলেছেন চেয়ারম্যান।
ভারতীয় রেলের তরফে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইরকন ইন্টারন্যাশনাল শ্রীনগর-বারামুলা ব্রডগেজ লাইনে প্রায় ১০ কিমি দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরির বরাত দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে। ৫ বছরের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ করার সময়সীমা থাকা সত্ত্বেও ৫৪ মাসে মাত্র ৩২ শতাংশের বেশি কাজ করতে পারেনি এইচসিসিএল। ফলে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দিয়ে ইরকন ২০১৭-র জুনে আবার দরপত্র আহ্বান করে টানেলের অসম্পূর্ণ অংশ তৈরির জন্য। তখনই বরাত পায় গ্যামন ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড কনট্রাক্টরস লিমিটেড।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)