Advertisement
০৪ অক্টোবর ২০২৩
Coromandel Express accident

কাজ সারার হুড়োহুড়ি, না কি নেপথ্যে অন্তর্ঘাত? করমণ্ডল দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে ঘনাচ্ছে রহস্য

স্টেশন ছোট হলে সেখানে প্যানেল ইন্টারলকিং ব্যবস্থা থাকে। বাহানাগা বাজার স্টেশনেও ছিল ইন্টারলকিং ব্যবস্থা। যার প্রধান উদ্দেশ্য,পয়েন্ট এবং সিগন্যালের মধ্যে নিশ্ছিদ্র সমন্বয় তৈরি করা।

An image of the accident

ঠিক কী কারণে করমণ্ডল এক্সপ্রেস এমন ভয়াল দুর্ঘটনার মুখে পড়ল? —ফাইল চিত্র।

ফিরোজ ইসলাম 
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৩ ০৭:৩৩
Share: Save:

প্রযুক্তিগত ত্রুটি? কাজে গাফিলতি? নাকি কারও হাত?

ঠিক কী কারণে করমণ্ডল এক্সপ্রেস এমন ভয়াল দুর্ঘটনার মুখে পড়ল, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রেল-প্রশাসনের অন্দরে। যে ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্যানেল ইন্টারলকিং বা রুট রিলে ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু এখনই এই ব্যবস্থাকে কাঠগড়ায় তুলতে চাইছেন না প্রাক্তন বা বর্তমান রেলকর্তারা। তাঁদের মতে, ওই ব্যবস্থায় হাত না পড়লে কিছুতেই যন্ত্রের ভুল হওয়া সম্ভব নয়।

পুরো প্রক্রিয়ায় রিলে-নির্ভর সিগন্যাল কী ভাবে বদল হচ্ছে, তার সব তথ্য ধরা থাকে ডেটা-লগার যন্ত্রে। রেলের দাবি, করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনার তদন্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে ওই ডেটা-লগার যন্ত্র, যা কার্যত বিমানের ‘ব্ল্যাক বক্স’-এরই সমতুল।

কী ভাবে কাজ করে রেলের রুট রিলে বা প্যানেল ইন্টারলকিং সিস্টেম?

রেল সূত্রের খবর, যে সব স্টেশনে একাধিক লাইন এবং পয়েন্ট (ট্রেনের লাইন বদলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা) রয়েছে, সেখানে ট্রেন চলাচলে দুর্ঘটনা এড়াতে প্যানেল ইন্টারলকিং অথবা রুট রিলে সিস্টেম লাগে। লাইন এবং পয়েন্টের সংখ্যা খুব বেশি হলে ব্যস্ত স্টেশনে রুট রিলে সিস্টেম থাকে।

স্টেশন ছোট হলে সেখানে প্যানেল ইন্টারলকিং ব্যবস্থা থাকে। বাহানাগা বাজার স্টেশনেও ছিল ইন্টারলকিং ব্যবস্থা। যার প্রধান উদ্দেশ্য, পয়েন্ট এবং সিগন্যালের মধ্যে নিশ্ছিদ্র সমন্বয় তৈরি করা— যাতে একটি ট্রেন স্টেশনের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম বা নির্দিষ্ট লাইন দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে কোনও ভাবেই সেই লাইনে অন্য ট্রেন এসে না পড়ে। ওই ট্রেনের জন্য পথ এক বার নির্দিষ্ট হয়ে গেলে সেই অনুযায়ী পয়েন্টের সজ্জা তৈরি হয়ে যায়। সবটাই বৈদ্যুতিন ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত। পয়েন্টের ঠিক জায়গায় চলে আসা নিশ্চিত হলে তবেই অনুকূল সিগন্যাল হয়। ট্রেন ঢোকার জন্য লাইন পুরোপুরি তৈরি থাকলে প্যানেল বোর্ডে ওই লাইনকে তখন হলুদ রেখার মতো দেখতে লাগে। ওই লাইন দিয়ে ট্রেন ঢুকে নির্দিষ্ট পয়েন্ট পেরোতে শুরু করলে ওই রেখাটি লাল হতে শুরু করে।

পয়েন্ট সেট করার সময়ে কোনও গোলমাল থাকলে ওই অংশের পয়েন্টের সঙ্কেত প্যানেল রুমে দপ দপ করবে এবং পুরো পথ লাল হয়ে থাকবে। পুরো ব্যবস্থায় পয়েন্টের সঙ্গে বসানো ‘রিলে’ বা বিশেষ সেন্সর প্রতি মুহূর্তে তার অবস্থান জানান দেয়। প্রশ্ন উঠেছে, এ ক্ষেত্রে লুপ লাইনের দিকে পয়েন্ট সেট হয়ে থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে মেন লাইনের সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেল? স্টেশন মাস্টারের প্যানেলে তা ধরা পড়ল না কেন?

এখানেই সব চেয়ে বড় ‘হেঁয়ালি’। দুর্ঘটনার অব্যবহিত পরে যে যৌথ রিপোর্ট লেখা হয়েছে, তাতে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে যাবতীয় পর্যবেক্ষণের কথা থাকলেও কার বা কোন বিভাগের ভুলে এমন কাণ্ড ঘটল, সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ওই রিপোর্টে দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণটুকু শুধু বলা হয়েছে। ভিন্ন কোনও মতও উঠে আসেনি। এখানেই বিষয়টি ভাবাচ্ছে প্রাক্তন এবং বর্তমান রেলকর্তাদের অনেককে।

রেল কর্তাদের একাংশের দাবি, নিচু তলায় বিভিন্ন রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সময় খুব কম পাওয়া যায়। ঘটনা-পরম্পরা দেখে রেলকর্তাদের একাংশের অনুমান, দুর্ঘটনার দিনে চেন্নাইমুখী মেন আপ লাইনে হয়তো সিগন্যালিং এবং পয়েন্টের কাজ হচ্ছিল। কিন্তু ট্রেনের সময় হয়ে আসায় ঝুঁকি নিয়ে সংক্ষেপেই সেই কাজ সেরে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই রেলকর্তাদের আশঙ্কা, ট্রেন দেরি হলে যেহেতু কৈফিয়ত দিতে হয়, তাই সেই ঝক্কি এড়াতেই এ ক্ষেত্রে খাতায়-কলমে সিগন্যাল দেওয়ার প্রক্রিয়াটিকে ব্যাহত করা হয়নি। বরং নির্দিষ্ট পয়েন্টের সেন্সর বা ‘রিলে’ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে— যাতে স্টেশন মাস্টার সময়মতো ট্রেনের পথ নির্দিষ্ট করে ‘থ্রু’ সিগন্যাল দিতে পারেন। কিন্তু ওই অল্প সময়ের মধ্যে পয়েন্টটিকে আর যথাস্থানে হয়তো ফিরিয়ে আনা যায়নি। রিলে বিচ্ছিন্ন থাকায় স্টেশন মাস্টার প্যানেলেও সেই সঙ্কেত ধরা পড়েনি। দুই রেলকর্তার ভাইরাল হওয়া কথোপকথনে এমন সম্ভাবনারই ইঙ্গিত মিলছে। এই প্রবণতাকে ‘অতি বিপজ্জনক’ বলছেন সুধাংশু মণির মতো একাধিক প্রাক্তন রেলকর্তা।

আবার রেলকর্তাদের অন্য অংশের মতে এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিত অন্তর্ঘাতও ঘটে থাকতে পারে। তাঁদের যুক্তি, করমণ্ডলের মতো ট্রেনের গতি এবং সময়ানুবর্তিতা সবার জানা। ফলে, সন্ধ্যার মুখে ওই ট্রেন আসার আগে মেরামতির কাজ করার অনুমতি কোনও সচেতন স্টেশন মাস্টার দিতেই পারেন না। ফলে ‘ইচ্ছাকৃত’ ভাবে রিলে বিচ্ছিন্ন করা বা ভুল পয়েন্ট সেট করার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। এই দু’টিই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, যার ইঙ্গিত মিলেছে রেলমন্ত্রীর কথায়।

করমণ্ডলের দুর্ঘটনা যেহেতু সিগন্যাল এবং পয়েন্ট সংক্রান্ত, তাই এখানে অ্যান্টি কলিশন ডিভাইসের ভূমিকা নেই বলে রেলের দাবি। তাদের যুক্তি, ওই যন্ত্র মূলত সিগন্যাল দেখে কাজ করে, পয়েন্ট দেখে নয়। একই যুক্তি খাটে ‘কবচ’-এর ক্ষেত্রেও। ট্রেন সিগন্যাল এড়ালে তা এই যন্ত্রে ধরা পড়ে, পয়েন্টের অভিমুখ বদল নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE