Advertisement
E-Paper

‘এমন আতঙ্কের অসুখে কাশ্মীরিদের আগে কখনও ভুগতে দেখিনি’

ভয় গ্রাস করে ফেলেছে গোটা কাশ্মীরকে। রীতিমতো সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন কাশ্মীরিরা। রাস্তাঘাটে মানুষের চোখে, মুখে আতঙ্কের ছাপ প্রকট। গত দু’দশকে যা কখনও দেখা যায়নি। উপত্যকার শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তারা প্রতি মুহূর্তে চোখের সামনে চেনা, অচেনা মানুষকে খুন হতে দেখছে। মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখছে। চলার পথের সামনে। রাস্তার পাশে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ১৭:২৮
কার চোখে ছাপ নেই সন্ত্রাসের, কাশ্মীরে?- ফাইল চিত্র।

কার চোখে ছাপ নেই সন্ত্রাসের, কাশ্মীরে?- ফাইল চিত্র।

এক দিকে লাগাতার জঙ্গিপনা। রক্ত, মৃত্যুর মিছিল। একের পর এক ব্যাঙ্ক লুঠ। অপহরণ। অন্য দিকে সেনাবাহিনী, পুলিশের গুলি, ধরপাকড়।

ভয় গ্রাস করে ফেলেছে গোটা কাশ্মীরকে। রীতিমতো সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন কাশ্মীরিরা। রাস্তাঘাটে মানুষের চোখে, মুখে আতঙ্কের ছাপ প্রকট। গত দু’দশকে যা কখনও দেখা যায়নি। উপত্যকার শিশুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। তারা প্রতি মুহূর্তে চোখের সামনে চেনা, অচেনা মানুষকে খুন হতে দেখছে। মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখছে। চলার পথের সামনে। রাস্তার পাশে।

টানা ১৭ বছর ধরে উপত্যকায় যাঁর পসার জমজমাট, সেই শীর্ষস্থানীয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, শ্রীনগরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর আরশাদ হুসেন মনে করেন গত দু’দশকের মধ্যে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ এতটা ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েননি কখনও।

আরও পড়ুন- পরমাণু বোমা মেরে সমুদ্রে ডোবানো হবে জাপানকে, হুমকি উত্তর কোরিয়ার

আরও পড়ুন- পরমাণু বিদ্যুত্ নিয়ে ভয়টা অযথা, একান্ত সাক্ষাত্কারে পরমাণু শক্তি সচিব

‘নিউজ এইটিন’কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে হুসেন বলেছেন, ‘‘আমি ১৭ বছর ধরে প্র্যাকটিস করছি কাশ্মীরে। এখানকার মানুষের চোখে, মুখে এতটা ভয় আমি এর আগে দেখিনি। অন্তত গত দু’দশকের মধ্যে কাশ্মীরিদের এতটা ভীত, এতটা সন্ত্রস্ত আমি দেখিনি।’’

তাঁর কাছে গত এক বছর ধরে যে রোগীরা আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগকেই রীতিমতো সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে দেখছেন উপত্যকার ওই বিশিষ্ট সাইকিয়াট্রিস্ট। হুসেন তাঁর গত দু’দশকের অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তার তুলে ধরেছেন ওই সাক্ষাৎকারে।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরশাদ হুসেনের মনে হয়েছে, উপত্যকায় লাগাতার জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস ও সেনা, পুলিশের অত্যাচার, ধরপাকড়ে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে শিশুরা। হুসেনের কথায়, ‘‘শিশুরা প্রতি মুহূর্তে চোখের সামনে মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখছে, মানুষকে খুন হতে দেখছে। এর ফলে তারা যে রকম সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে, তাতে সারাটা জীবন ধরে সেই ভয় তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। শিশুরা যে মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, তার জন্য আমরা ছাড়া আর কেউই দায়ী থাকব না।’’

কাশ্মীরের ওই বিশিষ্ট সাইকিয়াট্রিস্ট জানিয়েছেন, ২০০১ সালে প্র্যাকটিস শুরু করার পর থেকে উপত্যকার মানুষের চোখে, মুখে এতটা ভয়ের ছাপ এর আগে তিনি কখনও দেখেননি। তাঁর কাছে যে সব রোগী গত দু’দশক ধরে এসেছেন, তাঁরা কবুল করেছেন, রোগটা যে তাঁদের মনের, তা তাঁরা কেউই প্রথমে বুঝতে পারেননি। বহু দিন ধরে বুঝতে পারেননি। ফলে তাঁরা নানা রকমের ডাক্তারের কাছে ঘুরেছেন। শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসা করাতে। তাঁদের দিয়ে চেক-আপ করিয়েছেন। অনেক দিন পর তাঁরা বুঝতে পারেন রোগটা তাঁদের শরীরের নয়। মনের। আর তার পরেই তাঁর চেম্বারের বাইরে লাইন পড়ে যায় রোগীদের। আর সেই ভয়টা কাশ্মীরের নয়ের দশকের লাগাতার জঙ্গি সন্ত্রাস, অপহরণ, সেনা, পুলিশের অত্যাচারের পরিণতি। এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ট্রমা। যার থেকে চট করে তাঁদারে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনও আশা নেই। ‘‘এই ট্রমা ওই কাশ্মীরিদের প্রায় সারাটা জীবনই ভোগাবে।’’

হুসেন জানিয়েছেন, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে তিনি নতুন রোগী তেমন একটা পাননি। ওই সময় যে রোগীরা তাঁর কাছে আসতেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই স্মৃতিতে তখনও রয়ে গিয়েছে নয়ের দশকের জঙ্গিপনা, সন্ত্রাস, অপহরণ, সেনা ও পুলিশি নিগ্রহের ভয়। বিহ্বলতা। ২০০৮ সালের পর থেকে আবার সন্ত্রাসে কাবু হওয়া নতুন রোগী পেতে শুরু করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হুসেন। উপত্যকায় হু হু করে বাড়তে শুরু করে মনোরোগীদের সংখ্যা। তার পর নতুন মনোরোগী তাঁর চেম্বারে আসা আবার শুরু করে ২০১০ সাল থেকে।

হুসেন ওই সময় যে রোগীদের পেয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভয়ে কথাটুকুও বলতে পারেন না। চোখ বেশির ভাগ সময়েই থাকে ফ্যাকাশে হয়ে। তাঁরা কোনও প্রশ্ন করলে তার জবাব দিতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। আর সেই সব মনোরোগীদের বেশির ভাগই দক্ষিণ কাশ্মীরের বাসিন্দা।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরশাদ হুসেনের কথায়, ‘‘আমি দলে দলে রোগীদের দেখে যে ইঙ্গিত পেয়েছি, তা যদি হুবুহু মিলে যায়, তা হলে গোটা কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে মানসিক রোগটা মহামারী হয়ে উঠতে চলেছে। ১০ মিনিট অন্তর আমার কাছে নতুন নতুন মনোরোগী আসছেন। এটা আগে কখনও দেখিনি।’’

সম্প্রতি উপত্যকার ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষদের নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছেন হুসেন ও তাঁর সহযোগী মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা। তাতে দেখা গিয়েছে, উপত্যকার ৯০ শতাংশ মানুষই ভুগছেন ভয়াবহ ট্রমায়। যে ট্রমা থেকে সারাটা জীবনে তাঁদের রেহাই পাওয়ার তেমন একটা আশা নেই।

হুসেনের অভিজ্ঞতা, মূলত ধর্মপ্রাণ কাশ্মীরিদের খোদা (ঈশ্বর) আর তাঁদের হৃদয়ে নেই। যারা লম্বা দাড়ি রাখে আর ছোট পায়জামা পরে (বোঝাতে চেয়েছেন জঙ্গি), তাঁরাই খোদাকে যেন তাঁদের কাছে বেঁধে রেখেছেন!

নয়ের দশকেই দেখা গিয়েছিল, শিশুরা আর সাধারণ খেলনা নিয়ে খেলা করে না কাশ্মীরে। তারা খেলনা বন্দুক, কামান, মিসাইল নিয়ে খেলা করে। আর এখন সেই পরিস্থিতি কিছুটা বদলে গিয়ে শিশুদের দারুণ ভাবে ভীত, সন্ত্রস্ত করে দিয়েছে।

হালে তাঁর কাছে আসা একটি শিশু মনোরোগীর কথা জানিয়েছেন হুসেন। ১০ বছর বয়সী শিশুটি তাঁর কাছে এসেছিল সোপিয়ান গ্রাম থেকে। ক্লাস সিক্সে পড়ে। ভয়ে এক মাস ধরে ঘুমোতেই পারেনি শিশুটি। এক মাস আগে শিশুটির গ্রামে নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল জঙ্গিদের। যেখানে সেই সংঘর্যটা হয়েছিল, ওই শিশুটির বাড়ি ছিল তার এক কিলোমিটার দূরে। কিন্তু গুলির আওয়াজ আর বিস্ফোরণের শব্দ আর নানা মানুষের মুখে সেই সংঘর্ষের গল্প শুনে তার এমন দশা হয়েছে, রাতে আর তার দু’চোখের পাতা এক হয় না।

শিশুটির জন্য তাঁর পক্ষে কী করা সম্ভব?

হুসেন বলেছেন, ‘‘ও যাতে রাতে ঘুমোতে পারে, বড়জোর সেই ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু ওর স্মৃতি থেকে তো আর সেই ভয়, সন্ত্রাসের ছবিগুলি মুছে দিতে পারব না। সেই ভয়, সন্ত্রাস ওকে আজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে।’’

Kashmir Dr Arshad Hussain Top Kashmir Psychiatrist আরশাদ হুসেন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy