আপাতত তার ঠিকানা রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদের যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ কারখানা। আগামী ১ জুলাই ভারতীয় নৌসেনার কয়েক জন আধিকারিকের হাতে আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই ‘স্টেল্থ ফ্রিগেট’ আইএনএস তমালকে তুলে দেবে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ। তার পরে সে পাড়ি দেবে ভারতের উদ্দেশে।
রামায়ণে ইন্দ্রজিতের মেঘের আড়াল থেকে মায়াযুদ্ধের কৌশল কিংবা ‘ক্যাসিনো রয়্যাল’-এ ০০৭ ব্রিটিশ এজেন্ট ‘জেমস বন্ডের ‘স্কাইফ্লিট এস-৫৭০’। মূল লক্ষ্য একটাই— আড়াল থেকে শত্রুকে অতর্কিতে আক্রমণ। মহাকাব্য বা রুপোলি পর্দার পরিসর ছেড়ে বাস্তবের যুদ্ধেও ব্যবহার বাড়ছে সেই যুদ্ধ কৌশলের। সামরিক পরিভাষায় যে প্রযুক্তির নাম ‘স্টেল্থ টেকনোলজি’। পঞ্চম প্রজন্মের আধুনিকতম যুদ্ধবিমান থেকে পরমাণু চালিত ডুবোজাহাজ কিংবা নতুন জমানার যুদ্ধজাহাজে যা কার্যত অপরিহার্য হয়ে উঠছে।
আরও পড়ুন:
নৌসেনা সূত্রের খবর, শত্রুপক্ষের রাডারের নজরদারি এড়াতে বিশেষ ধাতুতে তৈরি আইএনএস তমাল। এই ইঞ্জিনও পৃথক প্রযুক্তির। ৩৯০০ টনের এই যুদ্ধজাহাজে হেলিকপ্টার ওঠানামা এবং ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে, শত্রুপক্ষের ডুবোজাহাজ খোঁজার জন্য অত্যাধুনিক ‘সোনার’ এবং তাকে ধ্বংস করার জন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টর্পেডো। ইতিমধ্যেই সফল ভাবে নৌযুদ্ধের মহড়ায় (সি ট্রায়াল) উত্তীর্ণ হয়েছে তমাল।
প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছিল ‘স্টেল্থ টেকনোলজি’র ব্যবহার। ছ’দশক পরেও শত্রুপক্ষের বিমান বা যুদ্ধজাহাজ চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত রাডারের মূল প্রযুক্তি প্রায় একই রয়েছে। যে এলাকা থেকে জল বা আকাশপথে শত্রুসেনার আগ্রাসনের আশঙ্কা রয়েছে, সেখানে নির্দিষ্ট সময় অন্তর রেডিয়ো তরঙ্গ ছুড়ে দেয় রাডার। যুদ্ধবিমান বা জাহাজের ধাতব দেওয়ালে সেই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ‘রেডিয়ো ওয়েভ’ ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলেই নিমেষে হিসাব করে নেওয়া যায় সেই বিমান বা জাহাজের অবস্থান, আকার, অভিমুখ এবং গতিবেগ। এর পর পাল্টা হামলায় তাকে ধ্বংস করার চেষ্টা শুরু হয়।
অর্থাৎ রাডারের নজরদারি এড়াতে হলে বাঁচতে হয় সেই রেডিয়ো তরঙ্গ থেকে। যা তাকে চিহ্নিত করে। রাডার প্রতিরোধী ‘স্টেল্থ টেকনোলজি’র লক্ষ্য একটাই— বিমান বা জাহাজের গায়ে ধাক্কা খাওয়া রেডিয়ো তরঙ্গকে ঠিক ভাবে রাডারের কাছে ফিরতে না দেওয়া। সে জন্য রেডিয়ো তরঙ্গকে শুষে নেওয়া বা দিগ্ভ্রান্ত করার পদার্থ এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ ধাতুশঙ্কর এবং কার্বন ফাইবারের তৈরি স্টেল্থ যুদ্ধবিমান কিংবা ফ্রিগেট ও ডেস্ট্রয়ার জাতীয় স্টেল্থ যুদ্ধজাহাজ সেই কাজ করতে পারে। যা সাধারণ ধাতুতে তৈরি যুদ্ধবিমানের পক্ষে সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন:
শুধু রাডার নয়। আধুনিক যুদ্ধে আকাশ এবং জলপথে প্রতিপক্ষের গতিবিধি নজরদারির বড় হাতিয়ার হল ‘ইনফ্রারেড সার্চ অ্যান্ড ট্র্যাকিং সিস্টেম’। বিমান বা যুদ্ধজাহাজের ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপকে ‘থার্মাল ভিশন’ প্রযুক্তির সাহায্যে চিহ্নিত করা হয় এই পদ্ধতিতে। সাধারণ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন থাকে নীচে। স্টেল্থ যুদ্ধবিমানে উপরের অংশে। ফলে ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও ইঞ্জিন থেকে নির্গত তাপ পুরোপুরি প্রশমন করা সম্ভব হয় না। এর জন্য হিমশীতল হাওয়া দিয়ে ইঞ্জিন নির্গত তাপ কমানোর ব্যবস্থা করা হয়। একই কৌশল প্রয়োগের পাশাপাশি স্টেল্থ ফ্রিগেট বা ডেস্ট্রয়ারের ইঞ্জিনও তুলনামূলক ভাবে খোলের অনেকটা ভিতরে থাকে।
আরও পড়ুন:
দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি শিবালিক গোত্রের স্টেল্থ ফ্রিগেট ২০১০ সাল থেকেই ব্যবহার করছে ভারতীয় নৌসেনা। বছর তিনেক আগেই ‘গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স’-এ তৈরি এই গোত্রের আইএনএস দুনাগিরি জলে ভেসেছে। ফ্রান্সের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত স্করপিন শ্রেণির স্টেল্থ ডুবোজাহাজ রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীরও। বর্তমানে বিশ্বের সেরা স্টেল্থ রণতরীটি আমেরিকার, ইউএসএস জুমওয়াল্ট ডেস্ট্রয়ার। তার পরেই নাম আসে রুশ প্রযুক্তিতে তৈরি তলোয়ার গোত্রের ফ্রিগেটের নাম। যার নবতম সংস্করণ আইএনএস তমাল।